ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ভারতে লকডাউনের পর শ্রমিকের ঘরে ফেরা নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতি

প্রকাশিত: ২৩:২০, ৩০ মার্চ ২০২০

ভারতে লকডাউনের পর শ্রমিকের ঘরে ফেরা নিয়ে অমানবিক পরিস্থিতি

অনলাইন ডেস্ক ॥ করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ভারত সরকারের জারি করা লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিকের ঘরে ফেরার মরিয়া চেষ্টাকে ঘিরে এক অবর্ণনীয় ও চরম অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানী দিল্লী কিংবা দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদ, কোট্টায়ামের মতো বিভিন্ন শহরে কর্মরত অসংখ্য শ্রমিক নিজেদের গ্রামে ফিরতে চাইছেন – সে জন্য তারা ট্রেন বা বাস, ট্রাক, যে কোনও ধরনের পরিবহনের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছেন। দিল্লীর আন্তঃরাজ্য বাস টার্মিনাসে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় উপছে পড়ছে। কাঁধে ব্যাগ বা মাথায় বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে, কেউ কেউ কোলের বাচ্চাকে নিয়ে যে কোনও ভাবে একটা বাসে বসার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এদিন দেশের বিভিন্ন রাজ্যকে কড়া নির্দেশ দিয়েছে, তাদের সীমান্ত সিল করে দিয়ে এই যাতায়াতের চেষ্টা যে কোনওভাবে রুখতে হবে – এবং লকডাউনের নির্দেশ কঠোরভাবে বলবৎ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এই পরিস্থিতির জন্য দেশবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু সেই সঙ্গেই তিনি বলেছেন দেশের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই। গাঁয়ে ফেরার বেপরোয়া চেষ্টা : ভারতের এই যে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক ঘরে ফিরতে এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তার প্রধান কারণ তারা আশঙ্কা করছেন বড় বড় শহরগুলোতে রুটিরুজি হারিয়ে তিন সপ্তাহের লকডাউনে তাদের এখন স্রেফ না-খেতে পেয়ে মরতে হবে। করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সরকারের নির্দেশ ছিল ‘স্টে পুট’ – অর্থাৎ যে যেখানে আছে আপাতত সেখানেই থাকুক। কিন্তু দেশের অসংগঠিত খাতের কোটি কোটি শ্রমিক, যারা ছোটখাটো দোকান-রেস্তোরাঁয় কাজ করেন কিংবা নির্মাণ শিল্পে দিনমজুরের কাজ করেন তারা এই নির্দেশ পালন করার সাহস দেখাতে পারেননি। বস্তিতে বাড়িভাড়া কীভাবে দেবেন, এতগুলো দিন কীভাবে নিজের বা পরিবারের পেট টানবেন – সেই চিন্তাতেই তারা ‘যা হবে হোক’ ভেবে পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ট্রেন, বাস নেই – তারপরও শত শত মাইল দূরে নিজের গ্রামের উদ্দেশে তারা হাঁটতে শুরু করে দিয়েছিলেন সেদিন থেকেই। রাজস্থান থেকে বিহার – প্রায় বারোশো মাইল পথ হেঁটে পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহসিক যাত্রা পর্যন্ত শুরু করেছেন কেউ কেউ। ভারতের বিভিন্ন হাইওয়ে-তেই চোখে পড়ছে এ ধরনের অভুক্ত বা আধপেটা খাওয়া মানুষের ক্লান্ত মিছিল। দিল্লির বাস টার্মিনাসে হাজার হাজার মানুষের ভিড় : এরই মধ্যে শনিবার রাজধানী দিল্লী জুড়ে খবর রটে যায়, উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শ্রমিকদের পৌঁছে দিতে এক হাজার বিশেষ বাসের ব্যবস্থা করছে। আগুনের মতো সে খবর ছড়িয়ে পড়তেই কাতারে কাতারে মানুষ ভিড় করেন পূর্ব দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাসে। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সব নির্দেশ তছনছ করে হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে লাইন দিয়ে হাতেগোনা দুচারটে বাসে ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু রবিবার থেকে সেই বাস সার্ভিসও বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ দিল্লী থেকে কেন্দ্রীয় সরকার সব রাজ্যকে কড়া নির্দেশ পাঠিয়েছে সীমান্ত সিল করে মানুষের এই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়া আটকাতেই হবে। উত্তরপ্রদেশের মতোই ভারতের আর একটি ‘হিন্টারল্যান্ড’ স্টেট বিহার, যেখান থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কাজের সন্ধানে দেশের নানা প্রান্তে যান। সেই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও পরিষ্কার জানিয়ে দেন, তিনি ভারতের নানা প্রান্তে আটকে পড়া বিহারের লোকজনকে ঘরে ফেরানোর জন্য বিশেষ ট্রেন বা বাসের ব্যবস্থা করার আদৌ পক্ষপাতী নন, “কারণ তাতে লকডাউনের মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে”। এদিকে রাজধানীতেও আজ দিল্লি পুলিশ শ্রমিকদের দিল্লী থেকে উত্তরপ্রদেশ যাওয়ার পথে বর্ডারে আটকে দিয়েছে। তারপরও কেউ কেউ মরিয়া হয়ে যমুনা নদী পেরিয়ে দিল্লি থেকে পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ঢোকার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন – এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। ফলে ভারতের বিভিন্ন বড় শহর থেকে এই লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক শেষ পর্যন্ত এই লকডাউনের ভেতর নিজেদের গ্রামে আদৌ পৌঁছতে পারবেন, সেই সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তবে যারা এর মধ্যেই দু-তিনদিন হেঁটে ফেলেছেন, তারা হয়তো কেউ কেউ পারবেন। মোদি সরকারের স্ট্র্যাটেজিটা কী? এই অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে চরম অব্যবস্থার মধ্যে জঁ দ্রেজ-সহ ভারতের বেশ কয়েকজন নামী অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ একটি যৌথ বিবৃতিতে মন্তব্য করেছেন, “এই লকডাউন জারির ঘোষণার আগে সরকারের কোনও আগাম প্রস্তুতি বা পরিকল্পনা যে ছিল না, তা একেবারে স্পষ্ট।” অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও ভারতের অভিবাসী শ্রমিকদের এই চরম দুর্দশায় ফেলার জন্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রবিবারও তার মাসিক রেডিও ভাষণ ‘মন কি বাতে’ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, “ভারতের স্বার্থেই এই লকডাউন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। নইলে অন্যান্য বহু দেশের মতো আমাদেরও করেনাভাইরাসের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।” তবে অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার জন্য ওই ভাষণে তিনি ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন। তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট, লকডাউন জারির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় যে এভাবে গরিব শ্রমজীবী মানুষের ঢল নামবে সরকার তা আঁচই করতে পারেনি। এখন বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এই শ্রমিকদের জন্য দুবেলা রান্না করা খাবার বা ফুড প্যাকেটের ব্যবস্থা করবে বলে ঘোষণা করেছে। দিল্লীতেই যেমন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তার সরকার কাউকে অভুক্ত থাকতে দেবে না। অন্য রাজ্যের গরিব মেহনতি মানুষের চিকিৎসারও ব্যবস্থা করা হবে । দেরিতে হলেও কেন্দ্র সরকারও সব রাজ্যকে এখন জরুরি ভিত্তিতে এই শ্রমিকদের দুবেলা পেট ভরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে বলেছে। ঘোষণা করা হয়েছে বিশাল অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজও। কিন্তু এই আতঙ্কিত, অভুক্ত মানুষজন সেই সরকারি ঘোষণায় আদৌ ভরসা রাখতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×