ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় একপ্রকার শিশু সংকট শুরু হয়েছে

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২২ জানুয়ারি ২০২০

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় একপ্রকার শিশু সংকট শুরু হয়েছে

অনলাইন ডেস্ক ॥ অনেকদিন ধরে ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইরানের মতো দেশ নারীদের বেশি করে সন্তান নেয়ার জন্য উৎসাহ দিতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখানে অর্থকড়ির বিষয় সম্পৃক্ত থাকে। কিন্তু সেটা কতটা কাজ করে? যেভাবেই আপনি ভাবুন না কেন, দেখা যাচ্ছে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় একপ্রকার শিশু সংকট শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহেই দুইটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের বৃহত্তম শক্তির দেশগুলো চিন্তায় পড়ে গেছে, কারণ সেখানে যথেষ্ট শিশু নেই। গত বুধবার, রাশিয়ান নারীদের বেশি করে সন্তান নিতে উৎসাহিত করার জন্য পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। প্রথম সন্তান নেয়ার জন্য একজন নারীকে ৭ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার দেয়া হবে। আর দ্বিতীয় সন্তান নেয়ার জন্য তিনি পাবেন ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। একই দিনে আরেকটি তথ্যে জানা যাচ্ছে যে, ২০১৯ সালে চীনে জন্ম নেয়া শিশুর সংখ্যা গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে এসেছে। এই দেশগুলো চিন্তায় পড়ে গেছে যে, তাদের নাগরিকরা দিনে দিনে বয়স্ক হয়ে উঠছে। তাদের উদ্বেগ, ভবিষ্যতে কাজ করার জন্য যথেষ্ট তরুণ কর্মী পাওয়া যাবে না। বেবি বোনাস : তবে এই সমস্যায় শুধুমাত্র চীন এবং রাশিয়া নেই। সারা বিশ্ব জুড়েই জন্ম হার কমছে। কিন্তু কেন মানুষকে সন্তান গ্রহণে উৎসাহিত করা কঠিন? ২০০৭ সালে বেবি বোনাস ঘোষণা করে রাশিয়া। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সন্তান গ্রহণের জন্য বোনাস হিসাবে অর্থ পাবেন বাবা-মা। কিন্তু তার প্রায় কোন প্রভাবই পড়েনি। জন্মহার এখনো কমছে। ২০১৫ সালে চীনের সরকার আশা করেছিল যে, শিশু জন্মের হিড়িক পড়ে যাবে, যখন তারা কুখ্যাত 'এক সন্তান নীতি' বাতিল করে। সেই বছর শিশু জন্মের হার সামান্য বেড়েছিল, কিন্তু সে পর্যন্তই। এশিয়ার শিক্ষা : দেখা যাচ্ছে, যখন মানুষজন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, কম সন্তান নেবে, তখন তাদের বোঝানো খুব কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়ার শিশু জন্মের সমস্যা গুরুতর পর্যায়ে পৌছেছে। গত বছর তাদের জন্মহার রেকর্ড সংখ্যায় নেমে আসে। পরিসংখ্যানের দিক থেকে বলতে গেলে, গড়ে নারীদের সন্তানের সংখ্যা একটিরও কম- মাত্রা ০.৮৯ শতাংশ। ১৯৭০ সালের পর থেকে দেশটির জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ কোরিয়া সবকিছুই করেছে-অভিভাবকদের ভর্তুকি দিতে প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। কোরিয়ার বাসিন্দা কিম জি-ইয়ে বলছেন, '' সন্তান নিতে আমি কখনোই আগ্রহী ছিলাম না।" কিন্তু বাবা-মায়ের অনেক চাপের কারণে তিনি একটি সন্তান নিয়েছেন। তিনি বলছেন, তার সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারি ভর্তুকির কোন ভূমিকা নেই এবং তার আরেকটি সন্তান নেয়ার কোন পরিকল্পনা নেই। ''সন্তান জন্ম দিতে গেলে আমার শরীরের কী পরিবর্তন হবে, এটা চিন্তা করে আমি ভীত হয়ে পড়ি,'' বলছেন ইউ ইন-আয়ে। '' এরপর আমি চাকরি-বাকরি ঠিক মতো করতে পারবো কিনা, সেটাও চিন্তা হয়।' ''সন্তান না নেয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। বাড়ির দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে, প্রাইভেট পড়াশোনার খরচ বাড়ছে।'' ''দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজে মাতৃ প্রবৃত্তি নিয়ে অনেক ধারণা চালু আছে। আমি মনে করিনা যে, সেসব আমি পূর্ণ করতে পারবো।'' সুতরাং সরকারি আর্থিক ভর্তুকি নিয়ে তার মনে কোন জায়গা নেই। সম্ভাব্য মায়েরা আগে থেকেই সরকারের কাছ থেকে সব খরচ পান। যখন শিশুর জন্ম হয়, তারা প্রথম সন্তানের জন্য মাসে ১৭০ ডলার পান এবং দ্বিতীয় সন্তানের জন্য আরো বেশি পান। শিশুদের যত্নের জন্য সরকারি কেন্দ্র রয়েছে। ভর্তুকি পাওয়া বেসরকারি কেন্দ্রও রয়েছে। কিন্তু সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন, এতে তেমন একটা কাজ হচ্ছে না। শিক্ষা ভীতি : তিন সন্তানের মা কিম ইয়ে-ইয়ুন বলছেন, ''দক্ষিণ কোরিয়ায় শিক্ষা ভীতি আছে এবং বেসরকারি পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি।'' তিনি বলছেন, সরকারি সহায়তা সত্ত্বেও তিনি তার সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটাতে পারছেন না। ''সরকার যদি এই সমস্যার সমাধান না করে, তাহলে সন্তান নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা কখনোই সহজ হবে না।'' এরপরে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার তীব্র প্রতিযোগিতামূলক কাজের সংস্কৃতি। কিম জি-ইয়ে বলছেন, ''আমি কখনোই আরেকটি সন্তান নিতে চাইনি।'' তার দুই বছরের একটি ছেলে রয়েছে। ''একটি সন্তান বড় করাই অনেক কঠিন, সুতরাং আমি তাকে ভালোভাবে বড় করার ব্যাপারেই মনোযোগ দিতে চাই।'' সরকারি কিছু অর্থ পেলেও, তাতে অবস্থার সামান্যই পরিবর্তন হয় বলে তিনি বলছেন। কিম জি-ইয়ে বলছেন, তিনি ভাগ্যবতী কারণ তিনি যে কোম্পানিতে কাজ করেন, সেটা বাবা-মায়েদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক। তিনি ১৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন এবং অফিসে শিশুদের রাখার একটি জায়গা পেয়েছিলেন- কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকম সুবিধা পাওয়া যায় না। ''আমি আমার অনেক বন্ধুকে চিনি, যারা সন্তান জন্ম দেয়ার পরে সামান্য সময় পেয়েছেন।'' ''অনেক কোম্পানি মাতৃত্বকালীন বা পিতৃত্বকালীন ছুটিতে উৎসাহ দেয় না।'' এটা হয়তো দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য বিশেষ একটি সমস্যা বলে মনে হতে পারে, কিন্তু একই সমস্যায় ভুগছে জাপানও। চীনও এ ধরণের সমস্যার কাছাকাছি রয়েছে। সারা বিশ্ব জুড়েই সন্তান জন্ম দেয়া না দেয়ার ক্ষেত্রে এটা বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। যখন একজন নারী পড়াশোনা শেষ করে চাকরিতে ঢোকেন, তার কাছে সন্তান জন্ম দেয়ার গুরুত্ব কমে যায়। নানা কারণে সেটা তার জন্য কঠিনও হয়ে যায়। উরুগুয়ে, থাইল্যান্ড, তুরস্ক এবং ইরানের মতো দেশগুলো দেখতে পেয়েছে যে, একবার যদি কম সন্তান নেয়ার ব্যাপারটি স্বাভাবিক হয়ে যায়, তাহলে সেই পরিস্থিতি পাল্টানো কঠিন। ছোট সফলতা : তবে স্থানীয়ভাবে এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করেছে কোন কোন ছোট শহরের বাসিন্দারা। গত নয় বছরে নাগি শহরের বাসিন্দারা তাদের এলাকার জন্মহার দ্বিগুণ করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। খুব আকর্ষণীয় ভর্তুকি দেয়ার কারণে সেখানে জন্মহার এখন ১.৪ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.৮। ফিনল্যান্ডের লেসটিজার্বি শহরে প্রতি শিশুর জন্মের জন্য ১১হাজার ইউরো করে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে চিন্তা করলে, এই শিশুদের একটি বড় অংশ পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা বা কাজরে জন্য বড় শহরে চলে যাবে। বড় শহরের অতিরিক্ত ব্যয়ভার বিশেষভাবে জন্মনিরোধে উৎসাহিত করে থাকে। ইউরোপের ছোট দেশ এস্তোনিয়া শিশু বোনাস হিসাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, কিন্তু সাফল্য হাতে গোনা। জন্মহার সামান্য বেড়েছে। কিন্তু সেজন্য এস্তোনিয়ার তিন সন্তানের একটি পরিবারকে মাসে দিতে হচ্ছে ৫৭৬ ডলার। অক্সফোর্ড ইন্সটিটিউট অব পপুলেশন এজিং এর ড. লেসন বলছেন, ''আমি মনে করি, এটা পুরোপুরি অর্থের অপচয়।'' ''অনেক সময়েই আমি আমার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করি, কেন মানুষ বেশি সন্তান নিতে চাইবে?'' তিনি বলছেন, জন্মহার কমে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ৪০ বছর আগে ইউরোপে এটা শুরু হয়েছে এবং দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোয় নারীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, যারা পরিবারের চেয়ে বরং তাদের শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চান এবং পেশা গড়তে চান। ''আমার মনে হয় না, আমরা আর সেই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চাইবো। তবে এটাও সত্যি কেউ কেউ সেটাই করতে চান,'' তিনি বলছেন। তারপরেও কেন জনসংখ্যা বাড়াতে এই তোড়জোড় : উন্নত দেশগুলোকে কর্মী সংকটের ব্যাপারটি সবসময়েই অভিবাসনের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। বিশ্বে এখনো অনেক তরুণ যুবক রয়েছে। আফ্রিকান বেশিরভাগ দেশে, পাকিস্তানে এবং ভারতে জনসংখ্যা এখনো বাড়ছে। তবে কিছু জাতীয়তাবাদী নেতারা এই বিষয়টির ওপরেই গুরুত্ব আরোপ করতে চান। গত সপ্তাহে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান ঘোষণা করেন যে, হাঙ্গেরির সব দম্পতিরা বিনা পয়সায় আইভিএফ সুবিধা নিতে পারবেন। গত বছর থেকে চার সন্তানের জননীদের করের বাইরে রাখার ঘোষণা দেয়া হয়। মি. ওরবান পরিষ্কার করে দিয়েছেন, কেন তিনি আরো বেশি শ্বেতাঙ্গ, খৃষ্টান শিশু চান। ''আমরা নানা ধরণের বা মিশ্রিত জাতি হতে চাই না। আমরা চাই না আমাদের বর্ণ, রীতিনীতি এবং জাতীয় সংস্কৃতি অন্যদের সঙ্গে মিশে যাক,'' তিনি বলছেন। কিন্তু এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে, এসব কিছু কাজে আসছে কিনা। ২০০৫ সাল থেকে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিয়ে আসছে হাঙ্গেরি, কিন্তু কোন প্রভাব দেখা যায়নি। আরো খারাপ হলো, তরুণদের ইউরোপের অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যেসব পরিবারে সন্তান থাকে, তাদেরকে অর্থ দিয়ে আসল অন্তর্নিহিত সত্যটি বেরিয়ে আসছে না যে- আধুনিক অনেক নারীই তাদের পেশাজীবন চালিয়ে যেতে চান। সুইডেন এবং ফ্রান্স এই বিষয়টিকেই প্রমাণ করেছে। তারা তাদের দেশে জন্মহার ইউরোপের গড় হারের সঙ্গে ধরে রেখেছে। কারণ তারা সন্তান নেয়ার পরে কাজে ফেরার ক্ষেত্রে ভালো পিতৃত্বকালীন ছুটি, বিনা পয়সার ভালো শিশু সেবা ও কাজের সংস্কৃতি তৈরি করেছে। ফলে কেউ পিতা-মাতা হতে গিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, নগদ অর্থ ছড়ানোর চেয়ে যদি ভালোভাবে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তা বেশি উৎসাহ তৈরি করতে পারে। সূত্র : বিবিসি বাংলা
×