স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী ॥ উত্তরের জেলা নীলফামারী জুড়ে লাউয়ের বাম্পার ফলন হয়েছে। লাউ চাষ করে জেলার কৃষকরা ব্যাপক লাভবান হচ্ছে। লাউ নিয়ে এখানকার কৃষকদের আর বৈরাগী হতে হচ্ছেনা। সেই আদিকাল থেকেই লাউ এর কদর ছিল ব্যাপক। যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতি ও গাছের প্রতি অকৃতিম ভালোবাসার বিকল্প নেই। আশ্চর্য্য হলেও সত্য জেলার যে কোন পথ ধরে গেলেই চোখে পড়বে সারি সারি লাউ চাষ। যে যেমন করে পেরেছে লাউ চাষ করেছে। মাচায় মাচায় ঝুলছে লাউ আর লাউ। যেদিকে চোখ যায় কেবল লাউয়েরই ছড়াছড়ি। লাউয়ের ভাল ফলন দেখে যে কারো ভাল লেগে যাবে। স্বল্প জমিতে অধিকহারে লাউয়ের চাষ করতে পেরে সন্তোষ চাষিরাও। আকারে গোলাকার এবং লম্বা দুই ধরনের লাউ এবার চাষ হয়েছে এ জেলায়।
সরেজমিনে দেখা যায় জেলার ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরীগঞ্জ, সৈয়দপুর উপজেলায় এবার ৫০০ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ করা হয়েছে। স্থানীয় বাজারে লাউ এর চাহিদা মিটিয়ে তা চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে। জেলা সদরের হাজীগঞ্জ গ্রামের গৃহবধু খালেদা আক্তার বললেন লাউ চাষে এতো লাভ আগে বুঝিনি। এবার আমি ও আমার স্বামী সিরাজুল মিলে বাড়ির ধারে একশত জমিতে লাউ চাষ করে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার টাকায় লাউ বিক্রি করেছি। অথচ লাউ চাষে খরচ হয়েছে মাত্র ১ হাজার টাকা।
জেলা সদরে সংগলশী ইউনিয়নের সুবর্ণখুলি গ্রামের নিমাই চন্দ্র রায় (২৭) কৃষি জমি রয়েছে ১ একর। পাঁচ বছর আগেও পরিবারটির ছিল অর্থনৈতিক সংকট। কৃষির আয় থেকে চার সদস্যের পরিবারের চলতো না ভরণপোষণ। একারণে ধারদেনা লেগেই ছিল পরিবারটিতে। এরপর থেকে সবজি আবাদ করে ফিরে এনেছে পরিবারের স্বচ্ছলতা।এবারে নিমাই চন্দ্র রায় সবজি চাষে ব্যবহার করছেন ৬৮ শতক জমি। এর মধ্যে আবাদ করেছেন লাউ ৪ শতক জমিতে। গত বছর একই পরিমান জমিতে সবজি আবাদ করে আয় করেছেন ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা।বাজারে বিক্রি করতে শুরু করেছেন লাউ। গত বছরের চেয়ে অধিক আয়ের আশা করছেন তিনি। তিনি জানান, শীতকালীন এসব সবজির ফলন উঠিয়ে একই জমিতে আবাদ করবেন ভুট্টাসহ অন্যান্য গ্রীস্মকালীন ফসল। এসব ফসল থেকে আয় আসবে অন্তান্ত ৫০ হাজার টাকা। সারা বছরের ওই আয় দিয়েই স্বনির্ভর হয়েছে তার ৪ সদস্যের পরিবার। গত ৫ বছরের আগাম সবজি আবাদ করে সে ধারদেনা পরিশোধ করে ভালো আছি আমরা।
গ্রামের হরিপদ রায় (৪০) বলেন, আগে যে পরিমান জমি ছিল এখনো তাই আছে। আবাদের কৌশল জানা না থাকায় অভাব অনটনে দিন কেটেছে। বানিজ্যিকভাবে লাউ চাষে যে অনেক লাভ হয় আগে জানতাম না। এখন অভাব তাড়িয়েছি। পরিবারের ৫ সদস্যের ভরণপোষণের জন্য আর চিন্তা করতে হয়না। এখন সমাজেও আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে।ডোমার উপজেলা হরিণচড়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম (৩৫) জানান ১২ শতক জমিতে লাউ চাষ করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার লাউ বিক্রি করেছেন। আরও বহু টাকার লাউ বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন। পাইকারি বিক্রেতা সমুজ আলী বলেন, বিষমুক্ত লাউ চাষ হয় নীলফামারীতে। ফলে নীলফামারীর লাউ এর চাহিদা বেশী।
এ ব্যাপারে চাষি আজগর আলী বলেন, লাউ চাষ তেমন একটা পরিশ্রমের নয়। ১ শতক জমিতে এক হাজার টাকা খরচ করে ১০ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। তবে নিয়মিত গাছের পরিচর্যা করতে হবে। রোপণ করতে হবে উন্নতজাতের বীজ।স্থানীয় কৃষি বিভাগের মতে বাংলাদেশের আবহাওয়া লাউ চাষের জন্য উপযোগী। লাউ প্রায় সব ধরণের মাটিতেই জন্মে তবে প্রধানত দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ মাটি লাউ চাষের জন্য উত্তম। লাউ একটি জনপ্রিয় সব্জী। লাউ, ডগা,পাতা সবই সব্জী হিসেবে খাওয়াযায়। কচি লাউ কুচিয়ে মিষ্টি জাতীয় ভুনি কদু রান্না জনপ্রিয়। লাউ সহজে হজম হয়, শরীর ঠান্ডা রাখে এবংকোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। শীতকালীন জলবায়ু লাউ চাষের জন্য বেশী সর্বোপযোগী। বছরের অন্য সময়েও চারা লাগিয়ে ফসলউৎপাদন করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারি লাউ-১, বারি লাউ-২ নামে উচ্চফলনশীল দুইটি জাত উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশে লাউ এর কোন অবমুক্তায়িত জাত নেই। বর্তমানে লালতীর সীড ক¤পানীর হাইব্রীড লাউমার্টিনা ও জুপিটার, ব্র্যাক সীড এর হাইব্রিড লাউ গ্রীন সুপার,ব্যাপক আবাদ হচ্ছে।
সুত্র মতে সেই আদিকাল থেকেই লাউ এর কদর ছিল ব্যাপক। শুধু সবজি হিসেবেই নয় পাকা লাউয়ের শক্ত খোসা এখনও দেশে-বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আদিকাল থেকেই এই শক্ত খোসা পানি রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে সবজির চাষ হয়েছে। এরমধ্যে ৫০০ হেক্টর জমিতে লাউ চাষ করেছে কৃষক।