স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর গ্রামের আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় নিহত মরিয়ম বেগমের পুত্রবধূ ও বাড়ির মালিক প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশুকে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ। সোমবার দুপুরে গ্রেফতারকৃতকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বরিশাল জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আব্দুর রকিব জানান, আগে গ্রেফতার হওয়া জাকির হোসেন ও জুয়েলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী হত্যাকান্ডের সাথে মিশরাত জাহান মিশুর জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে আসে। এরপর তাকে সলিয়াবাকপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এরআগে গ্রাম্য কবিরাজ জাকির হোসেন ও তার সহযোগি জুয়েল হাওলাদারকে আটকসহ লুটপাট করা মালামাল উদ্ধারের মাধ্যমে হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন করে র্যাব-৮ এর সদস্যরা। রবিবার সন্ধ্যায় ওই দুই ঘাতক বরিশাল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের বিচারক মোঃ এনায়েত উল্লাহর কাছে লোমহর্ষক ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা খুলে বলার পাশাপাশি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। পরে বিচারকের নির্দেশে তাদের জেলহাজতে পাঠানো হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করে বানারীপাড়া থানার ওসি শিশির কুমার পাল বলেন, রবিবার বিকেল তিনটার দিকে মামলায় গ্রেফতার হওয়া দুই আসামিকে বানারীপাড়া থেকে বরিশাল আদালতে পাঠানো হয়। আদালতে তারা স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
প্রবাসীর স্ত্রী মিশু ও ভাতিজী আছিয়া আক্তার আফিয়ার উদ্বৃতি দিয়ে থানা পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, ঘটনারদিন (শুক্রবার রাতে) গ্রাম্য কবিরাজ জাকির হোসেন ও তার এক সহযোগি তাদের ঘুম থেকে ডেকে তোলে। এসময় মিশুকে বিবস্ত্র করে জাকির হোসেন আপত্তিকর ছবি তোলেন। তার সাথে থাকা ব্যক্তিকে দিয়ে জাকির হোসেন বিবস্ত্র মিশুকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় বেশ কিছু আপত্তিকর ছবি তোলান এবং হত্যাকান্ডের বিষয়ে মুখ খুললে ওই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে বলে মিশুকে হুমকি প্রদান করা হয়।
এছাড়াও ধার্মিক পরিবারের ওই দুই সদস্যকে কোরআন শরীফ স্পর্শ করিয়ে এ বিষয়ে কাউকে না বলার জন্য কসম কাটানো হয়। হত্যাকান্ডের বিষয় কাউকে জানালে জ্বীনের মাধ্যমে তাদের ক্ষতি করা হবে বলেও কবিরাজ জাকির হোসেন ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। বিশেষ করে মিশুর দুই শিশু সন্তানের বড় ধরণের ক্ষতি হবে বলেনও হুমকি দেওয়া হয়।
আছিয়া আক্তার জানান, বিয়ে হলেও তার কখনও সন্তান হবে না এবং মিশু জানান-তার লিভাররোগ রয়েছে। এজন্য কবিরাজ জাকির হোসেন তাদের দুইজনকে বিভিন্ন তদবির দেন। বিষয়টি জেনে পুলিশ ওই বাসা থেকে তদবির দেওয়া তাবিজসহ অন্যান্য মালামাল উদ্ধার করেছেন। এছাড়া জাকির হোসেন জ্বীনের ভয় দেখিয়ে ওই পরিবারটিকে গত তিন বছর পর্যন্ত জিম্মি করে রেখেছে।
পুলিশের ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছেন-শুক্রবার ভোর রাত চারটার দিকে প্রবাসীর স্ত্রী মিশু তার ব্যক্তিগত বিকাশ একাউন্ট থেকে কবিরাজ জাকির হোসেনের বিকাশ একাউন্টে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। যা নিয়ে রহস্য আরও ঘণীভূত হয়। ফলে আলোচিত ট্রিপল হত্যাকান্ডে পরকীয়া প্রেম সংক্রান্ত বিষয়টি সামনে চলে আসে। এ হত্যাকান্ডে প্রবাসীর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশুর কোন সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না সে বিষয়টি খতিয়ে দেখার পাশাপাশি শুধু স্বর্ণালঙ্কার ও টাকা পয়সা লুটের কারণে না কি পরকীয়া প্রেমের কোন ঘটনা রয়েছে, তা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে পুলিশ।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা পুলিশ রবিবার প্রবাসীর স্ত্রী মিশরাত জাহান মিশু ও ভাতিজী কলেজ ছাত্রী আছিয়া আক্তার আফিয়াকে থানায় ডেকে আনেন। ওইদিন বিকেলে হত্যাকান্ডের শিকার তিনজনের জানাজা ও দাফনের সময় মিশু ও আছিয়াকে পুলিশ প্রহরায় বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদেরকে আবারও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রবিবার রাতেই আছিয়া আক্তার আফিয়াকে ছেড়ে দেয়া হয়। আর গ্রেফতারকৃত ঘাতক জাকির ও জুয়েলের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রবাসীর স্ত্রী ও নিহত মরিয়ম বেগমের পুত্রবধূ মিশরাত জাহান মিশুকে গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছেন।
থানা পুলিশের ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছেন- মিশরাত জাহান মিশুকে জড়িয়ে ঘাতক জাকির ও জুয়েলের স্বীকারোক্তির বিষয়টি রহস্যজনক বলে ধারনা করা হচ্ছে।
অপরদিকে ময়নাতদন্ত শেষে রবিবার বিকেলে হত্যাকান্ডের শিকার তিনজনের লাশের প্রথমে সলিয়াবাকপুর এ.রব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে নিহত মরিয়ম বেগমকে বানারীপাড়ার সলিয়াবাকপুর গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। অপর নিহত দুইজনের মধ্যে শফিকুল আলমকে স্বরূপকাঠির ছারছীনা দরবার শরীফে দ্বিতীয় জানাজা শেষে আকলম গ্রামে ও বানারীপাড়ার ধারালিয়া গ্রামে দ্বিতীয় জানাজা শেষে ইউসুফ হোসেনের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আলোচিত ট্রিপল মার্ডারের ঘটনার একদিন পর রবিবার সকালে প্রবাসী হাফেজ আব্দুর রবের ছোট ভাই ঢাকায় এনআরবি ব্যাংকে কর্মরত সুলতান মাহামুদ বাদি হয়ে বানারীপাড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।