শারদীয়া দুর্গাপুজো এবার ঢাকায় বেশ মহাসমারোহেই হচ্ছে। পূজামন্ডপগুলো বর্ণাঢ্য, আলোকসজ্জাও জাঁকজমকপূর্ণ। পুরনো ঢাকার একটি পূজামন্ডপে দেখলাম মাইকে হিন্দি গান বেজেই চলেছে। আবার উত্তরার বিশাল মাঠে স্থাপিত মন্ডপের পাশে আরেকটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্যে। সব ধর্মের মানুষই যাচ্ছেন, উপভোগ করছেন। ঢাকাবাসীর কাছে উপলক্ষটা বিনোদনেরও। নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো বটে, যদিও বনানীর পূজামন্ডপ থেকে আমার এক বন্ধুর দামী মোবাইলসেট চুরি গেল!
কার দায়িত্ব গণপরিবহন দেখার!
ঢাকার সড়ককে নিরাপদ করার ব্যাপারে ছাত্রদের আন্দোলনের বর্ষপূর্তিও সময়টাতে আবারও অনেক লেখালেখি হয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কতটা? কর্তৃপক্ষ চেষ্টার ত্রুটি করছে না, কিন্তু পরিস্থিতিরও উল্লেখযোগ্য উন্নতিসাধন সম্ভব হচ্ছে না। নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। বইয়ের বাজার বাংলাবাজারে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় ‘ভিক্টর ক্ল্যাসিক’ নামের একটি বাসে উঠে পড়ি, যেটি পল্টন-মালিবাগ কুড়িল হয়ে ফ্লাইওভার ডিঙিয়ে উত্তরায় যাবে। সিটিং গাড়ি। কিন্তু দাঁড়িয়ে লোক নিল। আচ্ছা তা না হয় নিক। স্বাভাবিক গতিতে চলুক। তা নয়। এক শ’ গজ পরেও যদি কেউ হাত ওঠায়, গাড়ি থেমে যায়, নব্যযাত্রীকে তুলে নেয়। এভাবে পুরো পথ। অথচ এটি সিটিং বাসের ভাড়াই নিচ্ছে। অন্য আরেকটা উদাহরণ দিই। উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটে চলে দুটি কোম্পানির এসি বাস বিআরটিসি এবং চাকা ঢাকা। বিআরটিসি যায় শাহবাগ হয়ে আর ঢাকা চাকা যায় রামপুরা মালিবাগ হয়ে। বিআরটিসির টিকেটের দাম ৭০ টাকা, অন্যদিকে চাকা ঢাকার টিকেটের দাম ১০০ টাকা। সম্ভবত ঢাকা শহরের মধ্যে কোন গণপরিবহনের টিকেটের সর্বোচ্চ মূল্য এটাই। সেদিন মতিঝিলে জরুরী কাজে যাব বলে চাকা ঢাকার টিকেট কেটে উঠে পড়ি। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস রবিবার। উত্তরা থেকে চার ভাগের এক ভাগও ভরল না বাসটির, তবে যেতে যেতে আধঘণ্টার মধ্যেই সব সিট পূরণ হয়ে গেল। ভাবলাম, যাক আর বোধহয় যাত্রী তুলবে না। কারণ এটি সিটিং বাস। তার ওপরে এয়ার কন্ডিশন্ড। কিন্তু দেখা গেল গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে লোক দাঁড় করানো হলো। কেন? বেশি টাকা দিয়ে এমন ঠাসাঠাসি পরিস্থিতি কেন? বুঝলাম সবার তাড়া। তাই দাঁড়িয়ে হলেও যেতে হবে। কিন্তু যারা বসে আছেন তাদের ঘাড়ের ওপরে যে ওইসব যাত্রীর নিশ্বাস পড়ছে! কেউ নামতে গেলে ঠেলাঠেলি আর ধাক্কাধাক্কি দশা চলছে। তার কি হবে? এটা কর্তৃপক্ষের বাণিজ্যিক বুদ্ধি ছাড়া আর কিছুই নয়। বাসের সংখ্যা বাড়ালে ব্যবসার ব্যয় বাড়বে। তাই সীমিতসংখ্যক বাসে নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করে সর্বোচ্চ মুনাফা তুলে নেয়া। এখানে সড়ক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কোথায়। তারা যদি বিষয়টি নজরদারি করত (হয়ত করে এবং নিয়মিত মাসোহারা তুলে নেয় অনৈতিকভাবে) তাহলে যাত্রীরা আরাম করেই গন্তব্যে যেতে পারতেন। ভেবেছিলাম বিআরটিসিতেই চলে এমন অনিয়ম। এখন দেখা যাচ্ছে চাকা ঢাকার ব্যবস্থাপনা আরও এক কাঠি সরেস।
ঢাকার রাস্তায় চারদিকে তাকালে অবশ্য নন এসি বাসই বেশি চোখে পড়ে। মতিঝিল-উত্তরা রুটে গত দশকেও অন্তত তিনটি কোম্পানির এসি বাস চলত। ঢাকাকে রাজধানী বলে ডেকে শুধু শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা। দিন দিন নাগরিক সুবিধা এখানে কমেই চলেছে। আমি না হয় সময়মতো এসি বাসে উঠতে পেরেছিলাম। যারা নন এসি বাসের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘেমে একাকার হন, তাদের কষ্টের কথা শোনাতে গেলে হয়ত পাঠক বিরক্ত হবেন। বিব্রতও হতে পারেন। কোন কোন বাসের ভেতরে ছোট ছোট ফ্যান রয়েছে। চালককে সেগুলোর সুইচ অন করতে বলবেন, দেখবেন চালক নিরুত্তর। অভিজ্ঞ কোন সহযাত্রী জানিয়ে দেবেন যে, সব ফ্যানই নষ্ট, কেবল চালকের মাথার ওপরেরটা ছাড়া।
ফিরে আসি এসি সার্ভিসের আলোচনায়। আবদুল্লাহপুর-ফার্মগেট-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী বিআরটিসির এসি বাসের এসি যথাযথভাবে কাজ করে না। অতিরিক্ত যাত্রী বহনও এর কারণ হতে পারে। সিটগুলো যথেষ্ট সঙ্কীর্ণ বলে দুই সারির প্রান্তের যাত্রীদের শরীরের কিছু অংশ সিটের বাইরে চলে যায়। আবার ঠাসাঠাসি গাদাগাদি করে যাত্রী ওঠানোয় আসনে উপবিষ্ট কিংবা দাঁড়িয়ে থাকা- সব যাত্রীরই অস্বস্তিকর অবস্থায় পথ পাড়ি দিতে হয়। তার অর্থ হলো বাস কর্তৃপক্ষ টাকা বেশি নিলেও প্রাপ্য সার্ভিস দিচ্ছে না। যাত্রীদের সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা হচ্ছে বিপুলসংখ্যক যাত্রী থাকতে এই রুটে মাত্র একটি এসি বাস সার্ভিস কেন? অবস্থা পর্যালোচনা করলে আমরা সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে আসতে পারি। স্পষ্টত এক্ষেত্রে অনৈতিক কিছু ঘটছে। যাদের বিষয়টি দেখার কথা, তারা চোখ বুজে আছেন। সরকারের কোন একটি খাত, সেটি যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, তা যদি ঠিকঠাক না চলে তাহলে ধরে নিতে পারি এটির উর্ধতন কর্তৃপক্ষ হয় অযোগ্য, নয় দুর্নীতিপরায়ণ। কিন্তু মানুষ দোষ দেয় সরকারকেই। ফলে সব দায় সরকারের ওপর চাপতে পারে। সে জন্যই আমরা মনে করি, অযোগ্য কিংবা দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের সরিয়ে সেক্টরে নিয়মশৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো জরুরী। দু’-চারজনের জন্য হাজার হাজার যাত্রী কেন নিত্য ভোগান্তিতে থাকবে। আর সরকারও বা কেন অপবাদ সহ্য করবে?
সিটিং সার্ভিস নিয়ে যে ‘চিটিং’ শুরু হয়েছে সেটি থামানোর দায়িত্ব কার? গত বছর নতুন করে সিটিং সিস্টেম চালু হওয়ার আগে আবদুল্লাহপুর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ৩নং লোকাল বাসে ভাড়া ছিল ১৮ টাকা। এখন সিটিং নামের একই বাসগুলো একই দূরত্বের যাত্রায় যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩৫ টাকা। নামে সিটিং হলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এই রুটের বাসগুলো এখন কোন কিছু তোয়াক্কা না করে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে বাসে লোক নিচ্ছে। তার সোজা অর্থ হলো সিটিং ঘোষণা দিয়ে একদিকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, অন্যদিকে লোকাল বাসের দশাও ফিরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী দায়িত্বশীল হলে অন্তত এই সিটিং বাসের ‘চিটিংগিরি’ নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে যেত।
পাড়ায় পাড়ায় জিম
পঞ্চাশ-পেরুনো কয়েকজন বন্ধু নতুন করে জিমে যাওয়া শুরু করেছেন। এটাকে ইতিবাচকভাবেই নিচ্ছি। মানুষ শরীরচর্চাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। ফলে অলিতে গলিতে গজিয়ে উঠছে জিম। মেয়েদের জিমের সংখ্যাও বাড়ছে। এক সময় ঢাকা শহরে পাড়াভিত্তিক অনেক ব্যায়ামাগার ছিল। দুই সিটি কর্পোরেশন মিলিয়ে এখনও কাগজে-কলমে ২৩টি ব্যায়ামাগার আছে। এর মধ্যে ২১টিই দক্ষিণ সিটিতে। কিন্তু ব্যায়ামাগারগুলো নামেই আছে নেই প্রশিক্ষক, নেই আধুনিক শরীরচর্চার সরঞ্জাম, নেই পরিবেশ। ভবনগুলো পুরনো, জরাজীর্ণ। আর ঢাকার ক্লাব বলতে আছে শুধু পরিচিত কিছু ফুটবল ক্লাব। এক জরিপে দেখলাম ঢাকা মহানগরীর ৬৪ শতাংশ স্কুলে খেলাধুলার কোন ক্লাসই নেয়া হয় না। বেশিরভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। রাজউক এবং ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারী জায়গায় প্রতিষ্ঠিত পার্ক ৪৭টি। কিন্তু বাস্তবে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় বড়জোর ১০টি, সেগুলোও নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। আর ১৯টি খেলার মাঠের মধ্যে ৮টি কোনমতে টিকে আছে। বাকিগুলো বেদখল হয়ে গেছে নগর কর্তৃপক্ষের লোকজনের চোখের সামনে। এখন ঢাকায় গড়ে উঠেছে স্নুকার ও বিলিয়ার্ড ক্লাব। আছে সাইবার ক্যাফে। আছে ফাস্টফুড আর ফুডকোর্টের আধিক্য। আছে কর্পোরেট জিমনেশিয়াম।
তরুণরা যাবে কোথায়? কোথায় পাবে তাদের প্রত্যাশিত বিনোদন?
মাঠা, বাখরখানি
পুরান ঢাকায় গিয়েছিলাম সন্ধ্যাবেলা। তবে সকালের রূপ তার দারুণ। আর কিছু ঐতিহ্যবাহী খাবার তো রয়েছেই। সেদিন খেলাম ‘ক্র্যাম চপ’। খাসির মাংসের টুকরো দিয়ে বানানো চপ, দেখতে চিতই পিঠার মতোই, তবে রং হলো পোড়ামাটির। দামও বেশ- ১২৫ টাকা। পুরান ঢাকার বিশেষজ্ঞদের মতে, সেখানের ঐতিহ্যপূর্ণ খাবারের তালিকায় মাঠা ও বাখরখানি অন্যতম। তবে স্বাদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। খাস্তা ও নিমসুখা নামের দুই ধরনের বাখরখানি রয়েছে। এর মধ্যে আকারে বড় কিন্তু পাতলা ও হাল্কা নিমসুখা বাখরখানির দেখা মেলে না বললেই চলে। বাজারে যে বাখরখানি এখন দেখা যায়, তা খাস্তা বাখরখানি। অনুজতুল্য সাংবাদিক আদনান শৌখিন সেদিনই একটি লেখায় পুরান ঢাকার সকালের ছবি তুলে এনেছেন। পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি লেখার অংশবিশেষ। লিখেছেন : ‘পুরান ঢাকায় ভোরটা বড় সুনসান। দিনমান যেখানে রিক্সা আর নানা যানজটে যাত্রীরা এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঠার মতো আটকে থাকেন, সেই ঢাকা ভোরের নরম আলোয় একেবারেই অন্যরকম। হাঁকডাক নেই, হুল্লোড় নেই, নেই গাড়ির প্যাঁ-পোঁ। দোকানপাট সব বন্ধ, রাস্তাগুলো ফাঁকা। এ সময় ঐতিহ্যের দ্বার খুলে বউনি করতে শুরু করে বাখরখানি আর মাঠার দোকানগুলো। এ দৃশ্য দেখে পুরান ঢাকায় বড় হওয়া মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে উঠতে পারেন।
খুব ভোরে পুরান ঢাকার বড় কাটরা, চকবাজার, বেগমবাজার, নাজিমউদ্দীন রোড, সাত রওজার মোড়ে মোড়ে যেন এক অন্যরকম সুনসান নীরবতা কাজ করে। অন্য সময় যেই অলিগলিতে রিক্সার জ্যামে আটকে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়, সেখানে গলিগুলো প্রায় জনশূন্য। দু-একটা রিক্সা গলি দিয়ে ধীরগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। রেস্তরাঁ ছাড়া দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ। অল্প কয়েকজন মানুষ হেঁটে আসা-যাওয়া করছে। এর মধ্যে মোড়ের গলিতে বিচ্ছিন্নভাবে মাঠা নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল কয়েকজনকে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাঠার দোকানে ক্রেতা বাড়তে লাগল। ভোরে পুরান ঢাকার বড় কাটরা এলাকা। বড় কাটারার রাস্তায় রতন ঘোষ নামের একজন মাঠার সসপ্যান, ছানা নিয়ে বসেছিলেন। একজন মাত্র ক্রেতা সেখানে। ২৫ বছর ধরে এ জায়গাটিতেই মাঠা বিক্রি করছেন বলে জানালেন রতন ঘোষ। বংশানুক্রমিক তারা এ ব্যবসায় যুক্ত। রতন বলেন, ভোর পাঁচটা থেকে মাঠা, ছানা নিয়ে বসেন। প্রতি গ্লাস মাঠা বিক্রি করেন ১০ টাকায়। সোয়ারীঘাটের কাছে আরেক মাঠা বিক্রেতা উত্তম ঘোষ বললেন, তিনি ২২ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। মাঠা, ছানার সঙ্গে মাখন, ক্ষীর বিক্রি করেন। বাসায় পরিবারের সবাই মিলে তৈরি করেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত ১০ থেকে ১২ লিটার মাঠা বিক্রি হয় তার।
নাজিমুদ্দীন রোড ধরে এগোতেই চোখে পড়ল বাখরখানির দোকান। দোকানে আবুল খায়ের নামের এক ব্যক্তি তার দুই কিশোর ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে বাখরখানি বানাচ্ছেন। আবুল খায়ের জানালেন, ৩০ বছর ধরে তিনি বাখরখানি বানান। দোকানটি তার ভাইয়ের। প্রতিদিন তারা চিনি ও পনির বাখরখানি তৈরি করেন। চিনি বাখরখানি প্রতি পিস তিন টাকা আর পনির বাখরখানি প্রতি পিস ১০ টাকা করে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার পিস বাখরখানি বিক্রি করতে পারেন।’
০৬ অক্টোবর ২০১৯
[email protected]