আধুনিক জীবনে নগর-মহানগরের ক্ষত হলো বস্তি। এ যেন এক অমোঘ অভিশাপ। বস্তিবাসী কারা? সমাজের সবচেয়ে অসহায়, লাঞ্ছিত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষ, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তারাই বস্তিবাসী। যুগে যুগে মানুষ এসে শহরের বস্তিতে কোনরকমে মাথা গুঁজে বেঁচে থাকার ফুরসত পেয়েছে। নদী ভাঙ্গনের অনিবার্য শিকার প্রান্তিক মানুষ ভিটেবাড়ি-জমিজমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে শহরে চলে আসত জীবন বাঁচাতে। তাদের ঠাঁই হতো বস্তিতে। কালে কালে বস্তির আবাসনেও পরিবর্তন এসেছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে মুনাফালোভীরা। বস্তিতে ভাড়ায় থাকতে শুরু করেছে স্বল্প আয়ের মানুষ। আগে নদীভাঙ্গা মানুষ শহরে আসত বাঁচার আশায়। এরপর গ্রামে কৃষি কাজ বা অন্য কোন জীবিকায় যুক্ত হতে না পেরে কিংবা অতি সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাওয়া মানুষ রাজধানীতে চলে এসেছে রিক্সা চালিয়ে হলেও বেশি আয়ের আকাক্সক্ষায়। শুধুই কি রিক্সা চালানো? বস্তিবাসী মানুষের রয়েছে বিচিত্র পেশা। দোকান চালানো, ফেরি করে পণ্য বিক্রি, কামলা খাটাÑ এসব পুরুষদের প্রধান জীবিকা। আর বস্তির নারীরা পোশাক শিল্পে কাজ জুটিয়ে নিয়েছে বেশি। যারা কাজ পায়নি তারা ধনী লোকের বা মধ্যবিত্ত পরিবারে গিয়ে গৃহকর্মী হয়েছে। সর্বত্রই জনসংখ্যার চাপ রয়েছে। বস্তিতেও বেড়েছে নতুন শিশুর সংখ্যা। কালে কালে একেকটা বস্তি হয়ে উঠেছে মানুষের চাপে ভারাক্রান্ত ও দিশেহারা। বেকার মানুষকে নানা অপকর্মে লাগানোর জন্য তো হাঁ করে বসেই থাকে নষ্ট মানুষ। ফলে মাদক ব্যবসার আখড়াও হয়ে উঠেছে অনেক বস্তি। নানা অপরাধ সংঘটিত হয়ে চলেছে এসব বস্তিতে। একদিকে মানবেতর জীবন, অন্যদিকে অপরাধের আগ্রাসন- এই দুই মিলিয়ে বস্তির মানুষ কিভাবে স্বস্তিতে থাকবে? তার ওপর আগুন লাগা এবং লাগানো এই দুইয়ের নিয়তির খেলায় মাঝে-মধ্যে নতুন করে সর্বস্ব হারানো বস্তিবাসীর হাহাকারে নগরীর বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এই তো কিছু দিন আগে মিরপুরের ঝিলপাড় বস্তিতে আগুন লেগে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার।
বস্তির মানুষের কল্যাণের কথা দেশের আগের কোন সরকার ভাবেনি। কারণ দেশে সেভাবে জনকল্যাণমুখী সরকারই ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার সমাজের হতদরিদ্র প্রান্তিক মানুষের জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে চলেছে। এর আগে দরিদ্র মানুষের জন্য আবাসন ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এবার বস্তিবাসীর জন্য ছোট ছোট ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বস্তির মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য তাদের প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনাও নেয়া হয়েছে। বাসস্থানের পাশাপাশি তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সুবিধা শতভাগ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বস্তিবাসীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে কারিগরি প্রশিক্ষণ, সেলাই শিক্ষা, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন ও মাছ চাষের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষিতদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এ খাতে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। জরিপ বলছে, দেশের ২৪ জেলার ২৯ শহরে ৪৫ হাজার বস্তি আছে। এসব বস্তি গড়ে উঠেছে প্রায় ৫ হাজার একর সরকারী জমির ওপর। রাজধানীতে হাজারো বস্তি থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীনে বড় বস্তি আছে ১১০টি। প্রত্যেকটি বস্তিই গড়ে উঠেছে সরকারী জায়গায়। এর মধ্যে শুধু রেলওয়ের জায়গার ওপরই গড়ে উঠেছে ৭০টি বস্তি। অন্য বস্তিগুলো সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে। সরকারের গৃহীত নতুন পদক্ষেপ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশ বস্তির অভিশাপমুক্ত হবে বলে আমরা আশা করতে পারি।