ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

জীবনানন্দের কবিতায় নারী

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৮

জীবনানন্দের কবিতায় নারী

‘ঝরা পালক’ কবির সাতাশ-আঠাশ বছর বয়সের রচনা। পূর্ণ যৌবন, যৌবনের বেদনা ও তৎকালীন বাঙালী ভদ্র যুবকের সেই নিষিদ্ধ বিষয়ে অবদমন ততদিনে তাঁর অভিজ্ঞতার মধ্যে ভালোভাবেই এসে গেছে। কিন্তু সেইসব বাসনা-বেদনার কবিতা যে কাব্যভাষায় ও ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছিল তা স্বতঃসিদ্ধ রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও, প্রধানত অগ্রজ মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল ইসলাম, সতেন্দ্রনাথ দত্ত এবং অনুদিত ওমর খৈয়ামের। প্রথম বই, সুতরাং ভাষায় স্বাভাবিকভাবেই অগ্রজদের প্রভাব থাকলেও নারীর কল্পনায়, স্বপ্নে ও বর্ণনায় তাঁর পরিণত পর্যায়ে যে অসাধারণ নিজস্বতা এসেছিল তা এই বইটিতেও মোটেই ঘুমন্ত ছিল না। কিছু কিছু কবিতায়, জায়গায় জায়গায়, স্পষ্টই আকার নিচ্ছিল পরবর্তীকালের জীবনানন্দের নিজস্ব পৃথিবীর মেয়েরা। স্বাভাবিক যৌবনের উদ্বেল কামনা ও নিজস্ব নারীধ্যান-স্থানকালের দূরত্বে এবং অন্য জীবনের নতুনত্বে মেয়েদের অপরূপ করে ভেবে নেয়ার কবিপ্রবণতা মিলেমিশে আছে এই ‘ঝরাপালক’ কবিতায় : ডালিম ফুলের মতো ফোঁট যার, রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল যার শাঙনের মেঘ,-আর আঁখি গোধুলির মতো গোলাপী রঙিন; আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে-কত দিন! পরবর্তী কালে ‘বললতা সেন’ পর্যায়ে ‘চুল যার শাঙনের মেঘ’ তাঁর মৌলিক কল্পনা-প্রতিভায় হলো ‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’। ‘ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট’, ‘রাঙা আপেলের মতো গাল’ হয়েছে ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’। এইখানে মেয়েরা যেন ক্রমশ বাংলা কবিতার ঐতিহ্যম-িত রূপ থেকে জেগে উঠে স্বভাবের গূঢ়তর রূপে রূপান্তরিত হলো। ‘আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন’ হলো ‘চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম/চিতা জ্বলে’। যে কয়েকটি কবিতায় জীবনানন্দ মেয়েদের বাস্তবতার মধ্যে রেখে মূর্তিময়ী করে বর্ণনা করেছেন সেখানে প্রায় সব সময়েই পটভূমিতে ছিল হেমন্তকাল, হেমন্তনিসর্গ। মৃত্যু, উদাসীনতা, ধূসরতা প্রেমিকাদের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছেÑ প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে; আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রান কার্তিকে প্রাণ তার ভরে গেছে। অথচ উজ্জ্বল বর্ণময় রূপসীদের তিনি প্রায়ই নিয়ে গেছেন ভোরের বা রাতের সমুদ্রতীরে। ‘বনলতা সেন’-এর প্রথম পর্যায়ে রূপকথা, পরাণকথা, বরিশালের নদী, কান্তার, ধানের মাঠ আর হেমন্তের কুয়াশা মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল একটি নারীমূর্তির জীবনানন্দীয় আর্কিটাইপ : মেয়েটির দেহ-বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা, কড়ির মতন শাদা মুখ, দুইখানা হাত তার হিম, চোখে তার যেন শত-শতাব্দীর নীল অন্ধকার, স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো, প্রাণ নির্জন পেঁচার মতো। কিন্তু এরই এক যুগ পরে দেখা যায়, নারীর রূপের থেকে নারীত্বের ধারণা বা ব্যক্তিত্বের ও সত্তার কথা বেশি স্পষ্ট হয়েছে জীবনানন্দের চেতনায়। সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা নারীরা যেন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ভঙ্গুর রূপের চেয়ে হৃদয়ের আলো বা অন্ধকার ধূসর হয়েও উদ্ভাসিত ও দৃঢ় হয়েছে। সময়ের তারা যেন দান, আবার যেন তারা দেবী। তাদের নিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের সমুদ্রতীরের সভ্যতা, যুবাদের ঈপ্সা, অভিমান ও বিষাদ, রাত্রির অন্ধকার আর ভোরের আলো উতরোল হয়ে আছে। তাদের সঙ্গ, অস্তিত্ব ও আকর্ষণ ক্রমশ আমাদের চেতনায় সৃষ্টির অর্থ, মানুষের যাত্রা ও জন্মের অর্থ স্পষ্ট করতে থাকে: দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়- শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলই অনন্ত সূর্যোদয়। এই নারীদের সম্পর্কেই জীবনানন্দ সম্ভ্রান্ততাসূচক ও দূরত্বব্যঞ্জক ‘মহিলা’ শব্দটি প্রথম উচ্চারণ করেছেন: এক. সুদর্শনার শরীর- এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন তোমার শরীর। দুই. শ্যামলীর মুখ- শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন;... তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল, দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল, নক্ষত্র রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব- শ্যামলী, করেছি অনুভব। তিন. সুরঞ্জনা- পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন;... তুমি সেই অপরূপ সিন্ধু রাত্রি মৃতদের রোল দেহ দিয়ে ভালোবেসে, তবু আজ ভোরের কল্লোল। এবং সুরঞ্জনার সংসর্গ মনে করিয়ে দেয় : আরো আলো: মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়। ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘আকাশলীনা’। এই কবিতাটি প্রসঙ্গে রনজিৎ দাশ বলেন : এই কবিতাটিকে, প্রথম পাঠে মনে হয়, একটি বেশ সরল, শান্ত প্রেমের কবিতা, যার ভিতরে কিঞ্চিৎ ত্রিকোণ নাট্যদ্বন্দ্বের আভাস, তবু কবিতাটি শেষ পর্যন্ত একটু উদাসীন ও সুদূর। কবিতাটির শুরুতে রয়েছে একটি দুর্দান্ত চিত্রকল্পের আদিম হাতছানি, ‘নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে’। একটু পরেই রয়েছে আধূনিক বাংলা কবিতার অতিবিখ্যাত একটি পঙ্ক্তি, ‘কী কথা তাহার সাথে?-তার সাথে।’ যে-পঙ্ক্তিটিতে রয়েছে একই শব্দের রূপভেদ ঘটিয়ে কাব্যসৃষ্টির এক নতুন চমক, এক নতুন গভীরতা। ‘তাহার’ শব্দের বাদশা, পরমুহূর্তেই, ম্যাজিশিয়ানের তাস-ওলটানোর ভঙ্গিতে, ‘তার’ শব্দের জোকারÑএই চকিত জাদুবলে, পঙ্ক্তিটিতে উদ্যত হয়ে আছে প্রেমের চিরন্তন ঈর্ষা ও সংশয়। এবং এই ছোট পঙ্ক্তিটির যে সূক্ষ্ম যতিবিন্যাসÑপ্রথমে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন, তারপরে একটি স্তম্ভিত ড্যাশ, এবং সবশেষে একটি বিস্ময়বোধক চিহ্ন- এই যতিবিন্যাসের ব্যঞ্জনাকে বিবেচনা করলে, পঙ্ক্তিটিতে রয়েছে আরো বেশি কিছু, যার মধ্যে হয়তো ওই অদৃশ্য প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকটির জন্যে প্রচ্ছন্ন সহানুভূতিও লুকিয়ে রয়েছে। বস্তুত, পঙ্ক্তিটির মধ্যে সেই বেচারি যুবকটি যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। জীবনব্যাপী জীবননান্দ নারীর প্রেম, সৌন্দর্য ও মহিমা খুঁজেছেন। তাইতো ঘুরেফিরে নারীর সৌন্দর্য ও অমল অন্তঃসারের কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘মিতভাষণ’এ বলেন জীবনানন্দ- তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন!... আমাদের নিয়ে যায় ডেকে শান্তির সঙ্ঘের দিকে-ধর্মে -নির্বাণে... মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে; বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা; ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সংকল্প স্বপ্নের উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা। তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রুষার জল, সূর্য মানে আলো; এখনো নারীর মানে তুমি,... ‘এখনো নারীর মানে তুমি’। তুমি মানে বিশেষ, মানে হৃদয়ের মানুষী। কিন্তু জীবনানন্দের প্রেমের কবিতায় প্রথম থেকেই কেমন বিষাদ আর বিদায় ছিল। গদ্যে যে-কথা অত বিষন্ন তীক্ষ্ণ আর তিক্ত ছিল কবিতায় সেইটেই হৃদয়ের আশ্রয় কিংবা দার্শনিকতার আড়াল খুঁজে নিয়েছিল। যেমনÑ তুমি জল, তুমি ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন তোমার দেহের বেগ... নিঃসঙ্গ বুকের গানে নিশীথের বাতাসের মতো একদিন এসেছিলে... দিয়েছিলে এক রাত্রি দিতে পার যত। ‘ধূসর পান্ডুলিপি’তে একটি কবিতার নাম ‘১৩৩৩’। নাম দেখে মনে হতে পারে কবিতাটিতে জীবনের সত্য আছে। বিয়ের দু’বছর আগে লেখা এই বিয়োগান্ত কবিতায় কবির উপলব্ধি হয়েছে ‘দেহ ঝরে, তার আগে আমাদের ঝ’রে যায় মন।’ প্রায় একই সময়ে লেখা হয়েছিল, রূপকথার গল্প বুনে, একপাশে, এই পৃথিবীরই একটি বাস্তব মেয়ের দশ দিকব্যাপী বিপন্নতা- দেখিতেছিলাম সেই সুন্দরীর মুখ, চোখে ঠোঁটে অসুবিধা...ভিতরে অসুখ। কে যেনো নিতেছে তারে খেয়ে !... এ ঘুমোনো মেয়ে পৃথিবীর,-ফোঁপরার মতো ক’রে এরে লয় শুষে দেবতা গন্ধর্ব নাগ পশু ও মানুষে। ১৩৩৩ বা ১৩৩৫-এরও প্রায় আট-ন বছর আগেকার ‘১৩২৬ এর কতকগুলো দিনের স্মরণে’ তিনি লিখেছিলেন- বিনুনি বেঁধেছ তাই- কাঁচপোকা টিপ তুমি কপালের ’ পরে পরিয়াছ... তারপর ঘুমায়েছ ; কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে পানের বাটার ‘পরে; নোনার মতন শরীরটি পাতি নির্জন পালঙ্কে তুমি ঘুমায়েছ... ‘মহাপৃথিবী’ রচনাকালে, দেখছি, নারীদের প্রসঙ্গে জীবনানন্দের মন আর তেমন সাড়া দিচ্ছে না। অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি এবং চিন্তা দিয়ে নারী বিষয়ে তাঁর মতামত: নারী ক্রমশ আর রক্তমাংস নয়, প্রকৃতির মতোই তারা অপরূপ- এবং সেই রূপ সহজেই সুদূরতার, শান্তির ও জ্ঞানের দ্যোতনা আনছে। তোমার মুখের রূপ যেন রক্ত নয়, মাংস নয়, কামনা নয়, নিশীথ দেবদারু দ্বীপ; কোনো দূর নির্জন নীলাভ দ্বীপ; এই কবিতার মাত্র তিন মাস পরে লিখলেন সেই বিখ্যাত কবিতা: -এই সব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তলমূর্তি: তবু, আহা, ইহাদেরই কানে অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যবুকের দল : একবার নক্ষত্রের পানে চেয়ে-একবার বেদনার পানে। কবি দুটি দিকই উপলব্ধি করেছিলেন : পৃথিবীর স্থ’ল হাতে সুন্দরীরা যেমন ব্যবহৃত হয় তেমনি গরিব কোনো জীবনের ডাকেও তো তারা বধির থাকে। ক্রমশ জীবনানন্দের মনীষা সৃষ্টি ও জীবনের এই আত্মবিরোধ ও অধঃপতন নিয়ে বেশি ব্যাপৃত হলো। ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘সাতটি তারার তিমির’-এ প্রেম বা অপ্রেম নিয়ে কবিতা খুবই কম। বরং জীবনানন্দ এখন বেশি ভাবিত মানুষ, জীবন, সমাজ, সভ্যতা, সৃষ্টি, এই যুগ, সময়, ভবিষ্যত, অতীত, ইতিহাস নিয়ে। কবি দেবারতি মিত্র বলেন : জীবনানন্দের জীবিতাবস্থায় তাঁর শেষ দিকের বইয়ে প্রেম বা অপ্রেমের কবিতার সংখ্যা খুবই কমে এসেছিল্ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কবির মনীষা ও প্রজ্ঞা ভাবাবেগহীন হয়ে ফল দিতে শুরু করেছিল, পাঠকের এরকম একটি কথা মনে হতে পারে। কিন্তু এখন, মৃত্যুর অনেক কাল পরে আমরা যখন তাঁর এযাবৎ অগ্রন্থিত কবিতার বিরাট ভা-ার পড়তে পেলাম, তখন ক্রমশ আমাদের ধারণা অন্য রকম হতে থাকল। শেষ দিকে তিনি অনেক কাল তথাকথিত প্রেম-অপ্রেমের গন্ডির বাইরে গিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছেন। ব্যক্তিসম্পর্কের সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন নৈর্ব্যক্তিক অকলঙ্কতায়, ব্যাপ্তিতে-যেখানে প্রকৃতি, সৃষ্টি ও নারীর আনন্দস্বরূপ কবিকেও পরিবর্তিত করছে। হে আকাশ, হে সময়গ্রন্থি সনাতন, আমি জ্ঞান আলো গান মহিলাকে ভালোবেসে আজ, সকালের নীলকণ্ঠ পাখি জল সূর্যের মতন। কবি যেমন ব্যাপ্তিতে পৌঁছেছেন, তেমনি অন্যদিকে সেই সবিশেষ মেয়েটিও নানা পদবীতে, নানা পরিচয়ে নিজেকে প্রসারিত করেছে- মনে পড়ে সেন রায় নওয়াজ কাপুর আয়াঙ্গার আপ্তে পেরিন- এমনই পদবী ছিল মেয়েটির কোনো একদিন ক্রমশ সেই মেয়েটি সমস্ত দেশ কাল, সমস্ত পার্থিবতা ছাড়িয়ে মহাপ্রকৃতির মতন চিহ্নহীনা, অথচ রহস্যময়ী- কোথাকার মহিলা সে? কবেকার? ভারতী নর্ডিক গ্রীক মুশ্লিম মার্কিন? অথচ সময় তাকে শনাক্ত করে না আর; সর্বদাই তাকে ঘিরে আধোঅন্ধকার; চেয়ে থাকি-তবুও সে পৃথিবীর ভাষা ছেড়ে পরিভাষাহীন। ‘পদ্মপাতার জল’ আমাদের সাহিত্যে ক্ষণস্থায়িতার একটি প্রাচীন ও সৌন্দর্যময় উপমা। এক সময়ে মেয়েরা ছিল তাঁর কবিতায় জলেরই ঢেউ, জলেরই নদী। প্রেমিকার অস্তিত্ব, মিলন ও ক্ষণস্থায়িত্ব বর্ণনা করেন : এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল : পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। জীবনানন্দ জীবনজুড়ে শুধু কবিতায় নারী, প্রেম, অপ্রেম টানেননি শিশুকন্যাদের প্রতিও অপরিসীম টানের উৎসারও দেখি। গদ্যে লেখা খুকুরানীর কথাও প্রকাশ পেয়েছে তাঁর কবিতায়- কচি মেয়েটি যেন পাখির ছানা- নরম নদীর মতো পাখা ঘাড় ভাঙা, মুখে রক্ত মাখা শেফালী বোঁটার মতো ফোঁটা ফোঁটা লাল আধ পোয়া রক্ত তুমি-কচি মেয়ে যেন লাল শাল পরে আছে-ঘুমাতেছে আমার এ ছোট মেয়ে...পাখির মতন কথা কয়... বলে এস... ‘ব্যথা পাও? কবে আমি মরে গেছি-আজও মনে কর?’ খুকুরানী মৃত নয়, জীবনানন্দের আপন সন্তানও তখন জীবিত, তবু তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, তাদের ভবিষ্যত ছিল মৃতের মতোই অসহায়, পাখির ছানার মতোই নিষ্ঠুরতার মুখাপেক্ষী। জীবনানন্দের কবিতায় মুলত নারীই প্রধান বিষয় নয়। তার বিষয়বস্তু বহুবর্ণিল। তাঁর পুরো কাব্যভাবনাজুড়ে আছে ডিসকোর্স। নারী, প্রেম, অপ্রেম, শিশু শুধু এক প্রধান সিম্বল। আসলে তিনি এক সম্পূর্ণ কবি যাকে কবি সার্বভৌম বলা হয়। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দই প্রথম পঙ্ক্তি নির্ভর সুসংবদ্ধ কাব্যার্থের ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দিয়ে তৈরি করেছিলেন কবিতার এক ভিন্নতর সংবেদী ভাবার্থ যা আধুনিক কাব্যপ্রকরণের দূরতম সম্ভাবনার সন্তান বলা চলে। প্রকৃতপক্ষে কবি জীবনানন্দ দাশ নারীকে নীল আকাশ, নীলিমা বলেই ভেবেছিলেনÑ সেই নীলিমার মধ্যে নারীই নীলিমা হয়ে বসে আছে।
×