অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেড় দশক আগে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতে শুরু করলেও এখন শ্লথ হয়ে পড়েছে। টানা তিন বছর প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এছাড়া বেশ কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রভাবও পড়েছে এ খাতে। কারণ, পোশাক কারখানা বন্ধের ফলে যেসব শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই গ্রামের মানুষ। এর বাইরে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও পিছিয়ে পড়ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। ব্যাংকে আমানত রাখা ও ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে গ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ৫৩১ কোটি ৬৯ লাখ (১৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স আসে। এরপর প্রতিবছরই রেমিটেন্স কমে যেতে থাকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আড়াই শতাংশ কমে গিয়ে রেমিটেন্স আসে এক হাজার ৪৯৩ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) তা সাড়ে ১৪ শতাংশ কমে দাঁড়ায় এক হাজার ২৭৭ কোটি ডলারে; যা ছিল আগের ছয় অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আবার বিজিএমইএ-এর তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে প্রায় ১ হাজার ২০০ ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ায় কয়েক লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে যেখানে ব্যাংকে মোট আমানতের ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ ছিল গ্রামের মানুষের, তিন মাস পর অর্থাৎ ২০১৭ সালের মার্চ শেষে সেখানে কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০১৭ সালের জুন শেষে গ্রামের মানুষের আমানতের অংশ কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ২৮ শতাংশ।
একইভাবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে যেখানে ব্যাংকে মোট ঋণের ১০ দশমিক ১৭ শতাংশ ছিল গ্রামের মানুষের, তিন মাস পর ২০১৭ সালের মার্চ শেষে তা কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০১৭ সালের জুন শেষে গ্রামের মানুষের ঋণের অংশ কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৭ শতাংশ।
এদিকে বিবিএস প্রকাশিত সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় জরিপেও বলা হয়েছে, গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় বেশি হচ্ছে। প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়াকে এর মূল কারণ বলে মনে করা হয়েছে।
বিবিএস-এর প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল শেষে গ্রামের মানুষের গড় মাসিক আয়ের চেয়ে গড় মাসিক ব্যয় হয়েছে বেশি। ২০১৬ সালে গ্রামীণ এলাকার প্রতি পরিবারের গড় মাসিক আয় ছিল ১৩ হাজার ৩৫৩ টাকা। আর তাদের মাসিক গড় ব্যয় করতে হয়েছে ১৪ হাজার ১৫৬ টাকা। বিবিএস ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৭ সারের মার্চ পর্যন্ত সময়ে সারা দেশের ৪৬ হাজার ৮০টি পরিবারের আয়-ব্যয়ের ওপর এ জরিপ চালিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘বেশ কিছুদিন আগেও গ্রামের মানুষ প্রবাসী আয় দিয়ে বিভিন্ন উপ-শহরে জমি কিনত। এখন গ্রামের মানুষের সেই অবস্থা নেই। এছাড়া গ্রামের মানুষের হাতে টাকা কমে যাওয়ায়ও জমির দাম কমে পড়েছে। এর ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’
অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘প্রবাসী আয় কমে যাওয়া ছাড়াও দেশের অনেক গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ হওয়ায় ৯ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। আর কাজ হারানোদের অধিকাংশই গ্রামের মানুষ। আবার গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার মতো কোন প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি। এর সঙ্গে গ্রামীণ এলাকায় বন্যায় কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতিও কমে গেছে। তিনি মনে করেন, দেশে কৃষি ও অকৃষি কোন ধরনের শিল্পও সেইভাবে গড়ে উঠছে না। চাহিদা অনুযায়ী গ্রামে নতুন করে কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। ফলে দেড় দশক আগে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়া শুরু করলেও এখন সেটি শ্লথ হয়ে পড়েছে। এর ফলে হয়ত এখন ব্যাংকে আমানত রাখা ও ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষের অংশ কমে গেছে।’
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘এখনও গ্রামের একটা বড় অংশ রয়েছেন দারিদ্র্য সীমার নিচে। দুই কোটিরও বেশি মানুষ অতিদরিদ্র। আর চার কোটির ওপরে রয়েছেন সাধারণ দরিদ্র মানুষ। এর বেশিরভাগই গ্রামীণ।’
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা রাখে যেসব প্রতিষ্ঠান, সেই সব প্রতিষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ হয়নি। আবার গ্রামের মানুষের আয় না বাড়লেও তাদের ভোগাচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের উচ্চ দাম। কারণ গত একবছর ধরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। পাশাপাশি ওই সময়ে শ্রমিকের মজুরি হারও কমে গেছে। এর অর্থ হলো, মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। ফলে আয়ের সিংহভাগই ব্যয় হয়েছে। এতে তার পক্ষে সঞ্চয় করার সামর্থ্যও কমেছে। এ কারণে ব্যাংকে আমানত রাখা ও ঋণ নেয়া এই দুই ক্ষেত্রেই গ্রামের মানুষের অংশ কমে গেছে। আর গ্রামীণ এলাকায় সঞ্চয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী আয় কমে যাওয়া।’