ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের;###;অনুষ্ঠানে গিফট ব্যাগে;###;কোরান শরীফ, তীব্র প্রতিক্রিয়া

বুয়েটের পিছু ছাড়ছে না উগ্র সাম্প্রদায়িক বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ৮ জানুয়ারি ২০১৮

বুয়েটের পিছু ছাড়ছে না উগ্র সাম্প্রদায়িক বিতর্ক

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ উগ্র সাম্প্রদায়িক বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট)। বুয়েট ঘিরে সাম্প্রদায়িক তৎপরতায় এবার নতুন মাত্রা দিল এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন! সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের খাসির কথা বলে গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এ্যালামনাইদের রি-ইউনিয়নে জায়নামাজ, কোরান শরিফ, হজ ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন, আর আমপারা ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। বুয়েটকে অব্যাহত সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ায় দায়ীদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সাবেক উপাচার্য থেকে শুরু করে অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থী। বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। এ্যালামনাইদের সার্বজনীন অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়ায় ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। জানা গেছে, গত শুক্রবার ছিল বুয়েটে এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের রি-ইউনিয়ন। যেখানে বর্তমান ও সাবেক উপাচার্য থেকে শুরু করে উপস্থিত ছিলেন শত শত বুয়েটিয়ান। ভালভাবেই চলছিল অনুষ্ঠান। তবে খাওয়া-দাওয়ার পর ব্যাগে স্যুভেনির আনতে গিয়েই ঘটে তোলপাড় সৃষ্টিকারী ঘটনা। যে বুয়েটে কিছুদিন আগেই একটি বিভাগের অনুষ্ঠানে সংখ্যালঘু হিন্দু শিক্ষার্থীদের খাসির কথা বলে গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনায় অস্থিরতা চলছে। যার তদন্ত প্রতিবেদনও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। সেখানেই রি-ইউনিয়নের মতো একটি বিশাল সার্বজনীন অনুষ্ঠানে স্যুভেনিরের ব্যাগে তুলে দেয়া হয় জায়নামাজ, হজ ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন, আর পকেট আমপারা। ওই রাতে অধিকাংশ শিক্ষক, শিক্ষার্থীই খাওয়া দাওয়ার পর ব্যাগ হাতে নিয়েই বাসায় চলে যান কিছু না দেখেই। তবে বাসায় ফিরে একে একে ব্যাগ খুললেই প্রকাশ হয়ে পড়ে সার্বজনীন এ অনুষ্ঠানকে সাম্প্রদায়িক রূপ দেয়া হয়েছে। এরপর গত দুুদিন ধরে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যেই বুুয়েটে ব্যাপক সক্রিয় ফেসবুক পেজ ‘বুয়েটে আড়িপেতে শোনা’ থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বুয়েটের ছাত্র কল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার বলছিলেন, আমিও স্যুভেনিরের ব্যাগ খুলে দেখি জায়নামাজ। বুঝলাম না এটা আমাকে কেন দেয়া হলো। এটি তো একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান। অন্যান্য অনেকের ব্যাগে দেয়া জায়নামাজ, কোরান শরিফ, হজ ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন, আমপারার কথা শুনে তিনি বলেন, এটা কোনভাবেই ঠিক হয়নি। এসোসিয়েশনের আয়োজক কমিটির ওরাই এটা ঠিক করেছে। তাই তাদেরই তো দেখা উচিত ছিল। অনেক সময় স্পন্সর যারা করেন তারা অনেক কিছু দেন। কিন্তু তাওতো সকলকে দেয়ার আগে পরীক্ষা করে দেখা উচিত ছিল। এখন যে কেউ এটা পেলে আপত্তি করতেই পারেন। কিন্তু বুয়েটের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক, শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছেন এবার কোনভাবেই অপরাধীদের পার পেতে দেয়া হবে না। ঘটনার সঙ্গে যারা আছেন তাদের খুঁজে বের করার দাবিতে তারা সোচ্চার। ফারহান দাউদ ফেসবুকে পুরো ঘটনার বর্ণনা সহকারেই তার প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘স্যুভেনির আনতে গিয়ে দেখি স্যুভেনিরের সঙ্গে একটা হজ ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন আর পকেট আমপারা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। এরপরে দেখি গিফটের প্যাকেটে জায়নামাজ। লে বাবা এইটা কি এজতেমার ময়দান নাকি এ্যালামনাইদের রি-ইউনিয়ন? (আমি নিশ্চিত না এজতেমার ময়দানে ফ্রি-তে জায়নামাজ দেয় কি না, সম্ভবত দেয় না) তো এখন যদি অন্য ধর্মাবলম্বীরা দাবি করেন যে আমাদের পকেট গীতা পকেট বাইবেল বা পকেট ত্রিপিটক দেয়া হোক তাহলে? যদি ধর্মচর্চার এতই ইচ্ছা থাকে তাহলে বুয়েট থিওলজিক্যাল সোসাইটি খুলে যত খুশি ধর্মসভা করুক কেউ তো মানা করবে না। এই অনুষ্ঠানে শিং নারানারি কেন?’ ঐদিকে জায়নামাজ দেখে যদি অন্যরা বলে (ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাগে জায়নামাজ দেয়ার ইতরামির কথা বাদই দিলাম) আমরাও তো ধর্ম মানি আমাদের এখন প্রার্থনার জন্য ঘণ্টা ধুপ মোমবাতি পাগড়ি দেয়া হোক গিফট প্যাকে, তাহলে?’ ফারহান দাউদ আরও বলেছেন, ‘একটা সার্বজননীন অনুষ্ঠানে ধর্মীয় জিনিস দেয়ার আইডিয়া কোন ধরনের সাম্প্রদায়িক এবং ইতর বদমাইশ লোকজনের মাথায় আসে আমরা সেটা জানতে খুবই আগ্রহী। এটা ভুল করে দেয়া হয়নি খুব ভেবেচিন্তে জেনেশুনে প্রতিক্রিয়া অনুমান করেই দেয়া হয়েছে। আমরা সেই সাম্প্রদায়িক বাটপারের নাম জানতে আগ্রহী এবং অনুষ্ঠান কমিটিকে এ ধরনের বদমায়েশির জন্য (এটা ভুল না) জবাবদিহি করতে হবে। এখন এই জায়নামাজ যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী কেউ ফেলে দেয় বা বাসার কার্পেট হিসাবে ব্যবহার করে তো আপনাদের অনুভূতির সুড়সুড়ির ঠেলায় সে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবে তো? না আমি এককালের ব্লগার হইলেও নাস্তিক না আস্তিক। শিশু বয়স থেকে নামাজ পড়ি কোরান পড়ি। নামাজ কোরান আরবী না জেনে মুসলমান হই নাই আমারে ধর্ম নিয়া লেকচার দিও না।’ তিনি ঘটনার প্রতিবাদে সকলকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, নিজের অবহেলাজনিত নিস্ক্রিয়তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অনুষ্ঠানেই এটা নিয়ে বিশাল একটা গোলমাল বাধানো উচিত ছিল। না যদি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ব্যাগে জায়নামাজ না দিয়ে শুধু মুসলিমদের হাতেই জায়নামাজ আমপারা ধরিয়ে দিত অথবা অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও তাদের ধর্মীয় প্রতীক উপহার দেয়া হতো তাহলেও এটা নিয়ে আমাদের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, এমন একটা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে ধর্মীয় তমকা লাগানোর অপচেষ্টার জন্য। কিন্তু একের পর এক ব্যাচমেন্ট সিনিয়র জুনিয়রের সঙ্গে দেখা হচ্ছে ৫-৭ বছর পরে এই হল্লার মাঝে এটা নিয়ে তখন কথা বলার কথা মনেই ছিল না। কিন্তু বলা উচিত ছিল। সবাই আনন্দ ফুর্তি করছে কেউ খেয়াল করবে না এই সুযোগে কি দারুণভাবে এই সাম্প্রদায়িক বদমাইশিটা করে নিলা কোনভাবেই এ ঘটনাটা ধামাচাপা পড়তে দেয়া উচিত হবে না। ফারহান দাউদ সকলকে নিরবতা ভেঙ্গে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘বাই দ্য ওয়ে, যদিও আমি লাইকপাপী, কিন্তু এইটা লাইক বা রি-এ্যাকশন প্রার্থী পোস্ট না। কাজেই লাইক রি-এ্যাকশন না দিয়ে আসেন এইটা নিয়ে কথা বলি। কি করা যায়, বা কি করতে পারি সেইটা সাজেস্ট করেন সবাই। চুপ করে ভদ্রলোকি না দেখিয়ে সবাই কথা বলি এই বদমাইশি নিয়ে। আমাদের নীরবতার কারণেই শুকুনেরা এতে বাড় বাড়তে পারে।’ কাফী ওয়াহিদ লিখেছেন, ‘আমি কালকে বাসায় এসে দেখলাম এই অবস্থা।’ সন্দিপন সায়নাল ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ঘটনায় রাগের চেয়ে লজ্জাই হচ্ছে বেশি। বিষয়টি যথেষ্ট সুপরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে। এই খবর পাবলিকলি গেলে আমাদের প্রতিস্থানের যে ভাবমূর্তি প্রকাশ পাবে সেইটা দারুণ লজ্জার। এ ঘটনার জবাবদিহি প্রয়োজন।’ ফাহমিনা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘আমি রাতে গিফটের প্যাকেটে জায়নামাজ দেখে বুজতেছিলাম না এই টা কেন দিসে। হজ ওমরাহ পালনের নিয়মকানুন আর পকেট আমপরা পাইনাই। ওটা বোধ হয় ৪ তারিখে যারা নিয়েছে তাদের জন্য উপহার! রাহাত ইবনে মুশফিক ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন, এবার কোন অপব্যাখ্যা দিয়ে পার পাওয়া যাবে না। এটা যদি খুব নিচু মানের সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে নাও হয়, মিনিমাম অন্য ধর্মের প্রতি অসম্মানের ধৃষ্টতা তো বটেই। লজ্জাজনক। আব্দুল জব্বার খান বলছিলেন, ‘আয়োজকদের কেউ এই গ্রুপে আছেন কি না জানি না। বিষয়টির ব্যাখ্যা পাওয়া দরকার। সরকারী অনুষ্ঠানগুলোতে সচেতনভাবেই প্রারম্ভে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পবিত্র বাণী পাঠ করা হয়। খাবারের মেনু ও সতর্কতার সঙ্গে বেছে নেয়া হয়। এটি আমাদের সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানও বটে। বুয়েটে এ ধরনের কর্মকা-ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওসমান গনি বলছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হননের জন্য দায়ীদের বের করে শাস্তি দিতে হবে, না হলে এ্যাসোসিয়েশনের মৃত্যু আসন্ন।’ মাহবুবুর চৌধুরী ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, ‘অভিজ্ঞতা থেকে কল্পনা করতে পারে এ রকম দু-একজন মাথা মোটা হোক বা সাম্প্রদায়িক হোক সবসময় থাকে। কিন্তু এত বড় একটা আয়োজন তো কেউ একা করেনি- কারো চোখে পড়ল না গিফটা ডিস্ট্রিবিউট হওয়া পর্যন্ত। অবাক হলাম।’ আমিনুল করিম চৌধুরী বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলাম ঢুকে গেছে সব জায়গাতেই পাঠ্যপুস্তক থেকে বুয়েট আরও কি দেখতে হবে কে জানে।’ মোহাম্মদ রাশেদুর রহমান হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বুয়েটকে এমনিতেই কিছুটা সাম্প্রদায়িক বলে মনে হয়.... সেটা অনেক আগে থেকেই।’ কিছুদিন আগে হিন্দু শিক্ষার্থীদের গরুর মাংস খাওয়ানোর ঘটনা টেনে হাসান মাসুদ বলেছেন, ‘আগেরবার গরুর মাংস এবাপর জায়নামাজ নিয়ে রাজনীতি। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা প্রত্যেকটা জায়গায় বিতর্ক তৈরির জন্য ওত পেতে আছে। যারা এই অনুষ্ঠানের কমিটিতে ছিল তাদের প্রত্যেককে এর জবাব দিতে হবে। কিন্তু এত বড় অনুষ্ঠানে কিভাবে এটা ঘটল? কারাই বা এটা করেছেন? বিষয়টি নিয়ে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আসলে এর সঙ্গে বুয়েট কর্তৃপক্ষের সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই। এর আয়োজন এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের। আপনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য ও এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বা জেনারেল সেক্রেটারি ড. সাদিকুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রতিবাদ ওঠার বিষয়টি তুলে ধরা হলে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো কত কিছুই বলা হয়। আমি বরিশালে আছি। ঢাকায় এসে বিষয়টি দেখব।’ তবে বিষয়টির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ঘটনার জন্য বুয়েটের সাবেক ও বর্তমানে সক্রিয় জামায়াতপন্থীদের দায়ী করেছেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি ওই অনুষ্ঠানে যাইনি। ওখানে জামায়াতীদের দাপট। ওরাই এসব করেছে। কিন্তু ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী থাকতে কিভাবে হলো? এমন প্রশ্নে সাবেক উপাচার্য বলেন, জামিলুর রেজা চৌধুরী তো ওদের নিয়েই চলেন। বুয়েটের আন্দোলনের সময়েও সে একই কাজ করেছেন।’
×