রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে। তারপর ধর্ম। আমি হিন্দু বলতেই গুলি করার অর্ডার দিয়েছে। গুলি আমার ঘাড় ও কোমরে লেগেছে। আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না। শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে...’। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এভাবেই ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা। শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় তাকে না ফেরার দেশে চলে যেতে হয়েছে। মৃত্যুর পর বর্বর পাক সেনারা চেষ্টা করেছে ইতিহাস বিকৃতির। কিন্তু সত্য অমোঘ। ইতিহাস ইতিহাসের নিয়মেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের নীলনক্সা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এসব হত্যাকা- ঘটিয়েছে। যার শিকার হয়েছেন শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, ডাক্তারসহ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা।
টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ও ছাত্ররা ॥ ২৫ মার্চের সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী শিক্ষক ও ছাত্ররা। এর কারণ হিসেবে সে সময়ের আন্দোলনকে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টাকেই চিহ্নিত করছেন ইতিহাসবিদরা। তারা বলছেন, যখন বাঙালী প্রতিরোধ শুরু করছে, তখন প্রতিরোধের স্বর নিশ্চিহ্ন করতেই ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলার পরিকল্পনা হয়েছে। এর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী গণমাধ্যম ও প্রশিক্ষিত বাহিনীও ছিল টার্গেট।
বুদ্ধিজীবী হত্যার কথা মনে পড়লেই মাথায় আসে ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। অথচ এর শুরু হয়েছিল সেই ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতে গণহত্যার প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্বর পাকবাহিনী নির্মমভাবে অন্তত ২০ শিক্ষকসহ দুই শতাধিক ছাত্র-কর্মচারীকে হত্যা করেছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. অজয় রায় গণমাধ্যমকে বলেন, অসহযোগ আন্দোলন মূলত গড়ে উঠেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহরুল হক হলের (তৎকালীন ইকবাল হক) স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলন পরিষদকে কেন্দ্র করে। তাই পাকবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম লক্ষ্য ছিল এই হলটি। কোন সুনির্দিষ্ট হিসেব না থাকলেও শিক্ষকরা বলছেন, এই হলের কম-বেশি ২০০ ছাত্রকে পাকবাহিনী হত্যা করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলাকারী পাকিস্তান বাহিনীতে ছিল ১৮ ও ৩২ নং পাঞ্জাব এবং ২২ নং বেলুচ রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটেলিয়ন। ২৫ মার্চের রাত্রি থেকে বিশেষ মোবাইল বাহিনী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক বিধ্বংসী রাইফেল, রকেট লঞ্চার, মর্টার ভারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কালো রাতের ঘটনা বলতে গিয়ে ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, রাত বারোটার পর পাকসেনারা জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে এবং প্রথমে মর্টার আক্রমণ চালায়, সেই সঙ্গে চলতে থাকে অবিরাম গুলি বর্ষণ। প্রথম আঘাতে ৩৪ ছাত্র প্রাণ হারান। ছাত্রদের কাছে আসা অনেক অতিথিও এই সময় প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ভৈরব কলেজের হেলাল, বাজিতপুর কলেজের বাবুল পল, জগন্নাথ হলের বদরুদ্দোজা, নেত্রকোনার জীবন সরকার, মোস্তাক, বাচ্চু ও অমর।
‘বিপদ আরম্ভ হয়ে গেল’ ॥ যুদ্ধ দলিলে ঢাকা বিভাগের গণহত্যা ও নির্যাতনের বিবরণ দিতে গিয়ে জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার স্ত্রী বাসন্তী রানী গুহঠাকুরতা উল্লেখ করেন, ‘১৯৭১ সলের ২৫ মার্চ সেই কালোরাতে আমরা স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিনের মতো খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই রাত নয়টার সময় রেডিও খুলে বসে ছিলাম। ঢাকা রেডিও থেকে আমরা সে রাতে দুর্যোগের কোন পূর্বাভাস পাইনি। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ শুনে আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা মেয়ে ‘মেঘনার’ ঘরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ প্রিলিমিনারি এবং অনার্স পরীক্ষার্থীদের খাতা দেখতে বসলেন। অকস্মাৎ জনতার ধুপধাম শব্দ শুনে আমার স্বামী এবং আমি দেয়ালের বাইরে গিয়ে দেখলাম, জনতা রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় গাছ, পানির ট্যাঙ্ক ও ইটপাটকেল দিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করছে। আমার স্বামী বিপদ বুঝতে পেরে আমাদের ফ্ল্যাটের প্রবেশপথ তালাবদ্ধ করেন। আমার স্বামী রাস্তার দিকে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে ভারাক্রান্ত মনে ‘বিপদ আরম্ভ হয়ে গেল’ বলে আবার মেয়ের কক্ষে গিয়ে খাতা দেখতে বসে গেলেন’।
লেখায় আরও বলা হয়, ‘আমি আজেবাজে চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত বারোটার দিকে অদূরে বোমার আওয়াজ শুনে জেগে উঠে দেখলাম, ইকবাল হল এবং রোকেয়া হলের দিক থেকে বোমার আওয়াজ ভেসে আসছে। আস্তে আস্তে অসংখ্য লাইট বোমা আকাশকে আলোকিত করে দিচ্ছে, আলোর ফুলকিতে দেখলাম বোমা ও গুলি বর্ষিত হচ্ছে। আমরা দু’জন গুলি ও বোমার কানফাটা আওয়াজ সহ্য করতে না পেরে খাটের তলায় বেডকভার বিছিয়ে নিরাপদে শুয়ে বর্বর পাক সেনাদের বীভৎসতার তাণ্ডব শুনছিলাম। পাশের কামরা থেকে আমাদের ঝিকে ডাকতে গেলে সে আসে না-আমরা সবাই গুলির অবিরাম গর্জনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।’
চারদিকে দেখলাম লাইট বোমের আলোর ঝলকানি ॥ বাসন্তী রানী গুহঠাকুরতা আরও লেখেন, ‘আমাদের ফ্ল্যাটটি কাঁপছিল-চারদিকে দেখলাম লাইট বোমার আলোর ঝলকানি। হিস হিস শব্দ শুনে আমার গায়ের লোম শিউরে উঠল-আমি উঠে গিয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম-আমার ফ্ল্যাটের প্রবেশপথের সামনে পাক সেনা-ভারি অস্ত্রবাহী সশস্ত্র আর্মি ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অল্পক্ষণ পরেই এক পাঞ্জাবী মেজর আমার গেটের লোহার জিঞ্জির হাত দিয়ে সজোরে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে আমার মেয়ে মেঘনার কক্ষের জানালার মসকুইটো নেট বেয়নেট দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে। মাথা ঢুকিয়ে আমাকে দেখে এক দৌড় দিয়ে ঘুরে রান্নাঘরের দরজা ভেঙ্গে আমাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। আমি আমার স্বামীকে বললাম পাক সেনারা আমাদের ফ্ল্যাট ঘেরাও করেছে- আমরা বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন।
আমার স্বামী আমার মেয়েকে অন্য কামরায় গিয়ে শুয়ে থাকতে বললেন, পাঞ্জাবী সৈন্যরা আমাদের কামরার দরজায় বুটের লাথি মারছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে আমার স্বামীকে বললাম, পাক সেনারা এসে গেছে, হয়তো তোমাকে গ্রেফতার করবে, তুমি তৈরি হয়ে নাও, বলে একটি পাঞ্জাবি তার হাতে দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ঘরে এসে দেখলাম- রান্নাঘরের পাশে বারান্দার দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আমার ‘আয়াকে’ কনুইয়ের আঘাতে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমার সামনে এসে জিজ্ঞাসা করল ‘প্রফেসর সাহাব হায়?’ আমি নিরুপায় হয়ে সত্য কথা বললাম, ‘হায়’। পাঞ্জাবী মেজর আবার বললো, উনকো লে যায়েগা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাহা লে যায়েগা?’ আমার কথার সন্তোষজনক উত্তর না দিয়ে অত্যন্ত অবজ্ঞার সুরে বললো, ‘লে যায়েগা।’
‘হোয়াই? ॥ সেদিনের বর্ণনায় বাসন্তী রানী আরও বলেন, ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে মেজর চলতে চলতে বলতে লাগলো, ‘ফ্লাটমে আওর কই জোয়ান আদমী হায়?’ আমি বললামÑ‘নাহি, ত হামারা একহী লাড়কি হায়।’ একথা শুনে মেজর বলল, ‘ঠিক হায়, লাড়কি কা ডার নাহি হায়”-আমার সঙ্গে যে কামরায় ছিলেন সেই কামরায় প্রবেশ করে আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে বাম হাত চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপ প্রফেসর সাহাব হায়?’ আমার স্বামী ইংরেজীতে বললেন, ‘ইয়েস’। পাঞ্জাবী মেজর বললো, ‘আপকো লে যায়েগা’। আমার স্বামী মোটা গলায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘হোয়াই?’ মেজর তার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে টেনে বাইরে নিয়ে গেল- তাদের আমি পেছনে পেছনে কিছুদূর গিয়ে তাদের আর দেখতে না পেয়ে কামরায় ফিরে এসে টেলিফোনের রিসিভার উঠিয়ে দেখলাম সবকিছু বিকল অচল হয়ে আছে। আমি এ সময় সবই বুঝতে পারলাম-আমরা বিপদগ্রস্ত, বিপন্ন। ফিরে দেখলাম-উপর তলার সিঁড়ির শেষ মাথায় মিসেস মনিরুজ্জামানকে পাঞ্জাবী জওয়ানরা ‘যাও, যাও, হাঁটো’ বলে তাড়া দিচ্ছে। ইতোপূর্বেই পাকসেনারা ড. মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, তার ভাগ্নে এবং প্রতিবেশী যুবককে টানাটানি করে ঠেলে ধাক্কিয়ে ধাক্কিয়ে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসার জন্য জোরাজুরি করছিল।
‘ওরা আমাকে গুলি করেছে ॥’ সময় যত যাচ্ছে সামনে আসছে বিপদ। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠছে বাস্তবতা। সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাসন্তী রানী আরও বলেন, মিসেস জামান সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে আমাকে বললেন, পাকসেনারা ওদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে বললাম-নিয়ে যেতে দিন, ওদের বাধা দিয়ে লাভ নাই- ওরা আমাদের ভাষা বুঝে না জোরাজুরি করলে মেরে ফেলতে পারে। এ কথা বলতে বলতে বাইরে আমি দুটি গুলির আওয়াজ শুনে দৌড়ে বালিশ হাতে অদূরে দাঁড়ানো মেয়েকে ধরতে গিয়ে পরপর আটটি গুলির শব্দ শুনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম-সিঁড়ির নিচে চারজনের দেহ গড়াগড়ি যাচ্ছে। গুলিবর্ষণ করার পরক্ষণেই পাকসেনারা সবাইকে কার্ফু জারির কথা ঘোষণা করে, দ্রুত ট্রাকগুলো নিয়ে চলে গেল।
মিসেস মনিরুজ্জামান তেতলা থেকে পানি নিয়ে এসে গুলিবিদ্ধ সবাইকে খাওয়ালেন-তিনি দৌড়ে এসে বললেন ‘দিদি আপনার সাহেব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছেন, আমার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি বাঁচবেন। ‘একথা শুনে আমি এবং আমার মেয়ে ‘মেঘনা’ দৌড়ে আমার স্বামীর গুলিবিদ্ধ দেহের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখলাম- আমার স্বামীর দেহ গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। তিনি বলছিলেন, ‘ওরা আমাকে গুলি করেছে, আমার শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। আমাকে তুলে ঘরে নিয়ে যাও।’ আমি কান্নার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম শুধু হায় হায় শব্দ করছিলাম। দোতলার যে ফ্ল্যাটে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সাহেব এবং অধ্যাপক আনিস সাহেব থাকতেন তাদের বকের প্রবেশপথে অটোমেটিক তালা ঝুলতে থাকায় পাকসেনারা সেখানে প্রবেশ করেনি। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পরও ওরা কেউ আমাদের অসহায় চিৎকার শুনেও আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। আমরা কোন রকমে স্বামীর রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত দেহ ধরাধরি করে আমাদের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে বারান্দার খাটে এলিয়ে দিলাম-আমার স্বামী জ্ঞান হারাননি তখনও। আমার মেয়ে ‘মেঘনা’ মনিরুজ্জামান সাহেবের ভাগ্নের পানি পানি বলে অসহায় আর্তনাদ শুনে আমাকে নিয়ে তার মুখে শেষ পানি দিয়ে আসল। পরক্ষণেই ছেলেটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
দূরে-অদূরে বৃষ্টির মতো অবিরাম গুলি বর্ষণ করছিল পাকসেনারা। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম পাকসেনারা জগন্নাথ হলের পূর্বদিকে ছাত্রদের কেন্টিনে আগুন লাগিয়ে দেয়- মাঝে মাঝে পাকসেনাদের সামরিক ট্রাকগুলো টহল দিচ্ছিল, চারদিকে শ্মশানের হাহাকার। পরের দিন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এবং ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত আমার স্বামীর ক্ষত বেয়ে রক্ত ঝরছিল-বাইরে সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা করতে পারিনি।
বারান্দায় পড়েছিল স্বামীর মৃতদেহ ॥ ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে কতিপয় লোকের সাহায্যে আমার স্বামীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করি। হাসপাতালে কোন লোকজন ও ডাক্তার ছিল না। দায়িত্বরত নার্সরা সাধ্যমত আমার স্বামীর সেবাযতœ করেছে। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি তার মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে সরিয়ে আনার অনুমতি পাইনি। তার পবিত্র মৃতদেহের সৎকার করতে পারিনি। আমার স্বামীর মৃত্যুর পরক্ষণেই পাকসেনারা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘেরাও করে- আমি স্বামীর মৃতদেহ নিয়ে আসার কোন উপায় না দেখে ডাক্তারদের উপদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ড. মালেকের বড় ভাই আব্দুল বারি সাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে তাদের গাড়িতে আমাদের স্কুলের সেক্রেটারি ড. এমএ ওয়াহিদ সাহেবের ২০নং ধানমণ্ডির বাসায় আশ্রয় লাভ করি। আমার স্বামীর লাশ চারদিন হাসপাতালে পড়েছিল-আমার ড্রাইভার ৩ এপ্রিল পর্যন্ত হাসপাতালের ওয়ার্ডের বারান্দায় আমার স্বামী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃতদেহ দেখে এসেছে।
‘সারা দেশটাই তো আজকে কাঁদছে ॥’ পান্না কায়সার সম্পাদিত ‘হৃদয়ে একাত্তর’ গ্রন্থে ‘স্বাধীনতার ক্ষতচিহ্ন’ শিরোনামে মেঘনা গুহঠাকুরতা ’৭১-এর ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরেছেন। বাবাকে নিয়ে তিনি লেখেন, ‘...বাবার সম্পূর্ণ জ্ঞান ছিল। ভারি গলায় বললেন, আমাকে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে। তারপর ধর্ম। আমি হিন্দু বলতেই গুলি করার অর্ডার দিয়েছে। গুলি আমার ঘাড় ও কোমরে লেগেছে। আমি আমার পা নাড়াতে পারছি না। শরীর প্যারালাইসিস হয়ে গেছে’। ...কিন্তু বাবাকে ঘরে এনেও তো নিস্তার নেই। রাস্তার ওপারেই হাসপাতাল। কিন্তু কার্ফু আর গোলাগুলির জন্য হাসপাতালে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। নরক কাকে বলে আমি ’৭১-এর ২৫ মার্চের রাত ও ২৬ এর দিন ও রাতগুলোতে জেনেছিলাম। নরক হচ্ছে অসহায়ত্ব। ভয় আর অসহায়ত্ব। সুচিকিৎসার অভাবে প্রিয়জন ক্রমেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এটা জেনেও কিছু করা যাচ্ছে না। ...আমার মনের মধ্যে কেবল ঘুরছে বাবার জন্য বরফ লাগবে, ওষুধ লাগবে। এক্সরে প্লেট লাগবে। স্যালাইন লাগবে। কিন্তু ৩০ মার্চের সকালে যখন হাসপাতাল পৌঁছালাম তখন এগুলো কিছুই লাগেনি। বাবা আর নেই। আমার কান্না সেদিন আর কেউই থামাতে পারেনি। মা, আমার শিক্ষক, ডাক্তার, বন্ধু বান্ধব। শুধু পেরেছিল একজন নার্স- সম্পূর্ণ অচেনা, অপরিচিত নার্স। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে কেবল বলেছিল-‘তুমি কেঁদে কি করবে, সারাদেশে তোমার বাবার মতো কত মানুষকে মেরেছে ওরা। সারাদেশটাই তো আজকে কাঁদছে’।
লেখায় আরো বলা হয়, ‘...বাবার মৃতদেহ আমরা পাইনি। তার ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা ছিল তিনি চহবঁসড়হরধ-য় মারা গেছেন। ইঁষষবঃ ডড়ঁহফ-এ নয়। সেই সার্টিফিকেট মা গ্রহণ করেননি। তাই পাকিস্তান সরকার যখন বিদেশে দূত পাঠিয়ে রটিয়ে বেড়াচ্ছিলেন যে জগন্নাথ হলে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী যুদ্ধ করেছে। যার ফলে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আর গোবিন্দচন্দ্র দেব ক্রসফায়ারিং-এ মারা গেছেন। তখন এটা আমাদের দায়িত্ব হয়ে গেল যে দেশে থেকে বাবার হত্যাকে প্রমাণ করতে হবে। নয় মাস ভরে বহু লোকজন বন্ধুবান্ধব পরিচিতরা আমাকে আর মাকে আশ্রয় দিয়েছে। কখনও যৌথভাবে। কখনও পৃথকভাবে। সেই অভিজ্ঞতা এখানে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না’।
...ড. রাব্বির স্ত্রীর মুখে শুনলাম ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সার কথা। উনি এক এক করে যখন চেনা চেনা নামগুলো বলছিলেন, তখন গুলির মতোই বিঁধছিল বুকের ভেতর। হায় বাংলাদেশ! কী নির্মম তোমার জন্মযন্ত্রণা! কি বষাদে ভরা তোমার জন্মলগ্ন! শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দিনটিকে তাই মনে হচ্ছিল বড়ই করুণ, বড়ই শূন্য’।