নিখিল মানখিন ॥ দেশের সকল চিকিৎসককে তাদের ব্যবস্থাপত্রে কোন ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য সম্পূরক) জাতীয় আইটেম না লেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এতদিন চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে লেখার অজুহাত দেখিয়ে ফার্মেসিসহ বিভিন্ন দোকানে অনুমোদনহীন ও নিম্নমানের ফুড সাপ্লিমেন্ট (খাদ্য সম্পূরক) বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান ওষুধ আইন অনুযায়ী, কোন প্রকার ফুড বা ফুড সাপ্লিমেন্ট সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন, বিক্রয় ও বিতরণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সরকারী নিষেধাজ্ঞা মানছে না বিক্রেতারা। এগুলো কী উপাদানে তৈরি, তা দেখার কর্তৃপক্ষ নেই। বাজারজাত করতেও অনুমোদন লাগছে না। ওষুধের দোকানে বা সামনের টেবিলে সাজানো থাকে নানা খাদ্য সম্পূরক। পাইকারি বাজার থেকে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। বিক্রিও প্রচুর বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চিকিৎসকেরাও ব্যবস্থাপত্রে নাম লিখছেন। আর্থিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ও লাইন ডিরেক্টর (হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট)-এর স্বাক্ষরে জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৬তম বৈঠকে ফুড সাপ্লিমেন্ট নামের আইটেম ডাক্তাররা যেন ব্যবস্থাপত্রে না লেখেন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেই মোতাবেক দেশের সকল চিকিৎসকরা তাদের ব্যবস্থাপত্রে কোন ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট জাতীয় আইটেম না লেখেন, সে জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে এক শ্রেণীর চিকিৎসক সুচিকিৎসার নামে উচ্চমূল্যে বিভিন্ন ফুড সাপ্লিমেন্ট পণ্য (স্টেরয়েড সমৃদ্ধ ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফুড সাপ্লিমেন্ট মিনারেল ও জিংক) প্রেসক্রিপশনে লিখে দেন। বিভিন্ন কোম্পানির এসব আইটেম ডাক্তাররা রোগীদের প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছেন। অন্যদিকে রোগীরা সরল বিশ্বাসে প্রতারিত হচ্ছেন।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক সৈকত কুমার কর বলেন, ওষুধ ফার্মেসিগুলোতে ফুড সাপ্লিমেন্ট সামগ্রী বিক্রয়, প্রদর্শন ও মজুদ নিষিদ্ধ। কিন্তু অধিদফতরের পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন সময় ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডাক্তাররা শুধু ওষুধ প্রেসক্রাইব করবেন। তাদের প্রেসক্রিপশনে ফুড সাপ্লিমেন্ট প্রেসক্রাইব করার নিয়ম নেই বলে জানান মহাপরিচালক।
এর আগে এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল সরকার। এতে বলা হয়েছিল, ফার্মেসিতে কোন প্রকার ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি করা যাবে না। শুধু অনুমোদিত ওষুধ বিক্রি করতে পারবেন তারা। কিন্তু ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতারা তখন এই বলে যুক্তি দেখান, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ফার্মেসির লোকজন ওষুধ বিক্রি করেন। চিকিৎসকদের লেখা কোন প্রেসক্রিপশনে ফুড সাপ্লিমেন্টের নাম থাকলে আমাদের করার কিছুই থাকে না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর জানিয়েছে, খাদ্য সম্পূরক উৎপাদন ও বিক্রির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। অন্যদিকে বিএসটিআই বলছে, এগুলো খাদ্যের তালিকায় পড়ে না। বিপণনে তাদের অনুমতির দরকার নেই।
কেরানীগঞ্জের ছোট কুশিয়ারবাগে একটি বাড়ির তৃতীয়তলায় একটি অভিযানে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত খাদ্য সম্পূরক তৈরির কারখানার সন্ধান পান। এটি ছিল মোঃ রাসেল নামে এক ব্যক্তির কারখানা। আদালত কারখানার বর্ণনায় লিখেছে, মেঝেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কতগুলো লাল রঙের ক্যাপসুল, কৌটা, কৌটার ওপর লাগানোর স্টিকার, বিভিন্ন ধরনের ওষুধের পাতা (স্ট্রিপ)। মাঝখানে একটি তোষক ভাঁজ করে গদি তৈরি করা। এখানে বসে ক্যাপসুলের ভেতর ময়দা, স্যালাইন ঢুকিয়ে তৈরি হয় ‘হরমোন বর্ধক’সহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। কম দামী ওষুধের মোড়ক পরিবর্তন করে ‘বেশি দামী’ করার কাজটিও এখানে হয়ে থাকে।
র্যাব সূত্র জানিয়েছে, রাজধানী ও এর আশপাশে রাসেলের কারখানার মতো শতাধিক কারখানায় তৈরি হচ্ছে ভিটামিন, মাল্টিভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফ্রুট ভিটামিন, এ টু জেড ভিটামিন। বড়ি, সিরাপ, ক্যাপসুল, নরম ক্যাপসুল (সফট ক্যাপসুল) আকারে এসব বাজারজাত করা হচ্ছে। চটকদার মোড়কে বিএসটিআই কর্তৃক অনুমোদিত, জাতীয় বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের ফর্মুলা অনুযায়ী তৈরি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান বিভাগে বা পরমাণু শক্তি কমিশনে পরীক্ষিত-এসব কথা লেখা আছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, মিশ্রণ যন্ত্র, সেদ্ধ করা যন্ত্র, মোড়কজাত করা যন্ত্র, ক্যাপসুল জোড়া যন্ত্র দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেড় থেকে দুই লাখ টাকায় এসব যন্ত্র কিনে অনেকেই খাদ্য সম্পূরকের কারখানা খুলে বসেছেন।
উপাদান
কেরানীগঞ্জের আরেকটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত দেখেন, একটি পাত্রে লাল রঙের ঘন আঠালো তরল সেদ্ধ করা হচ্ছে। চিনির দ্রবণ আর কাপড়ের রং দিয়ে ওই মিশ্রণ তৈরি হয়েছে। ওই তরল বাজারজাত হচ্ছে ‘ভিটামিন সিরাপ’ হিসেবে। এর আগে আমিনবাজারের হিজলা পশ্চিম পাড়ায় রং, চক পাউডার আর চিনির শিরা মিশিয়ে তৈরি করা শক্তিবর্ধক ‘ভাইটন প্লাস’ সিরাপের কারখানায় অভিযান চালায় র্যাব।
হায়রে ট্যাবলেট
মিটফোর্ডে ট্যাবলেট বা বড়ির খোলা বাজার আছে। ৩০ থেকে ৫০ পয়সা দামে এসব বড়ি বিক্রি হয়। বোতল কিনতে পাওয়া যায় পাশের আরমানীটোলা ও বাবু বাজারে। হাজার হিসাবে বড়ি কিনে তা বোতলে ভরা হয়। তারপর প্রতিষ্ঠিত ওষুধ কোম্পানির ছাপ তাতে লাগানো হয়। নিজেদের তৈরি করা মোড়কে বোতল ঢুকিয়ে বাজারে ছাড়া হয়। কখনও নামের বানানে একটু এদিক-ওদিক করে তৈরি হয়ে যায় নতুন নাম। বড়িগুলো কী উপাদানে তৈরি, তা জানেন না বাজারজাতকারীরাও।
চীনা ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি
গত বছর র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত পল্লবীর একটি বাড়িতে গিয়ে ভিটামিন বড়ি মোড়কজাত করার সময় এফএম মেডিরয়েল ওভারসিজের মালিক মনিরুল আলমকে আটক করেন। মনিরুল রয়্যালবোন, রোবন, রোমেগা, কেফরিল, রয়্যাল প্লাস নামের মোড়কের ছোট কৌটায় (৩০টির) সবুজ ও সোনালি রঙের নরম ক্যাপসুল বাজারজাত করতেন। মোড়কের গায়ে লেখা মেড ইন ইউএসএ, ম্যানুফ্যাকচার্ড বাই বস্কোজেন ইনক, ক্যালিফোর্নিয়া, ইউএসএ, মার্কেটেড বাই মেডিরয়্যাল ওভারসিজ, ঢাকা, বাংলাদেশ। তবে ওই বড়ি চীন থেকে আমদানি করা হয়েছিল।
আমদানি-সংক্রান্ত কাগজপত্রে দেখা যায়, চীনের সিরিও ফার্মা থেকে পাঁচ লাখ বড়ি আমদানি করা হয় দুই হাজার ৯৫০ মার্কিন ডলারে। খুচরা হিসাবে একটি বোতলে ভরা ৩০টি বড়ির মূল্য দাঁড়ায় ১৫ টাকার মতো। সব বোতলে ভরা একই ট্যাবলেট, ৩০টি করে। অথচ দাম আলাদা। রোবনের বোতলের দাম ৩৭৩ টাকা। আবার রয়্যাল প্লাসের দাম ৬৪০ টাকা।
এদিকে, ভেজালবিরোধী অভিযানের মধ্যেই রাজধানীসহ সারাদেশের ফার্মেসিতে অবৈধভাবে অবাধে বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্টের (খাদ্য সম্পূরক) ব্যানারে স্টেরয়েড সমৃদ্ধ ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, মিনারেল ও জিং/ সমৃদ্ধ ওষুধ। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের আরোপিত বিধিনিষেধও মানছেন না অসাধু ব্যবসায়ীরা। এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট ও ওষুধ উৎপাদন বাজারজাতের সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ১০০ কোম্পানি। বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে এবং অবৈধভাবে ফুড সাপ্লিমেন্ট ও ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে অসাধু চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। এতে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সূত্র জানিয়েছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর অনেক আগেই এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের ফার্মেসিতে ফুড সাপ্লিমেন্ট সামগ্রী বিক্রয়, প্রদর্শন ও মজুদ নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এ বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করছে না মুনাফাখোর অসাধু চক্র। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে দেশে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফুড সাপ্লিমেন্টের বাজার রয়েছে। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে এ অসাধু ব্যবসায়ী চক্রটি। নামীদামীসহ নামকাওয়াস্তেরর অনেক ওষুধ কোম্পানি অবৈধভাবে ফুড সাপ্লিমেন্টের ব্যানারে স্টেরয়েড সমৃদ্ধ ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, মিনারেল ও জিং সমৃদ্ধ ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন ও বাজারজাত করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ফুড সাপ্লিমেন্ট ডিভিশন এবং এ জাতীয় পণ্য বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকতে হবে এবং তা ফার্মেসিতে বিক্রি করা যাবে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব ফুড সাপ্লিমেন্টের অধিকাংশ মোড়কে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) পরীক্ষিত বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু অনুমোদনের কথা বলা নেই। ভোক্তাদের আস্থা অর্জনে এই কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট কিনতে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) লিখে থাকেন চিকিৎসকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস, গার্ডিয়ান হেলথ কেয়ার, সিলগালা করে দেয়া ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বিভিন্ন কোম্পানি চীন, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তানসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নামে ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। দেশের প্রায় ওষুধের দোকানে তা বিক্রিও হচ্ছে অবাধে। কেমিকো ফার্মাসিউটিক্যালস বায়োজিন, প্রতীক জুনিয়র ও প্রতীক সিনিয়য় নামে ৩টি ওষুধ ফুড সাপ্লিমেন্ট নামে উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এ ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন করতে হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির পৃথক প্ল্যান থাকার নিয়ম থাকলেও এ কোম্পানির তা নেই। গার্ডিয়ান হেলথ কেয়ার ডাবের পানি ও টেস্টিসেল-এন নামে দুটি ফুড সাপ্লিমেন্ট উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। এছাড়া মাল্টি ভিটামিন-এস, মাল্টি ভিটামিন-ডিএস, স্প্রিলুনা, ওমেগা-৩-সহ (ফ্লাকসিড অয়েল) নানা ধরনের ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে অবাধে। বিষয়টি রাষ্ট্রীয় মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরও জানে। কিন্তু ফার্মেসিতে অবৈধ ফুড সাপ্লিমেন্টবিরোধী অভিযান তেমন চালানো হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আবদুল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, এ দেশের ফার্মেসিতে অপ্রয়োজনীয় অনেক উপকরণ পাওয়া যায়। দেখার কেউ নেই। ডাক্তারি পরামর্শ নিয়ে কিছুসংখ্যক ফুড সাপ্লিমেন্ট কোন কোন রোগীর চিকিৎসার অংশ হিসেবে দরকার হয়ে থাকে। তবে সেগুলো ফার্মেসিতে রাখার বিষয়ে চিকিৎসকদের করার কিছুই নেই। আর সেগুলো ফার্মেসিতে রাখার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নেবেন।