হিগস-বোসনের নামকরণ
১৯৬৪ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ পিটার হিগস একটি পেপার প্রকাশ করেন। ছিল তো ‘ল্যান্ডমার্ক’ পেপার। কারণ সেই পেপারে- ‘প্রাথমিক কণিকাদের (এলিমেন্টারি পার্টিকলস) কেন ভর থাকবে’র কথা বলেন তিনি। সেই সঙ্গে আরও বলেন, একটি ত্রিমাত্রিক ‘ক্ষেত্র’ বিশ্বব্রহ্মা-ের আনাচে কানাচে র্সবত্র (স্থানব্যাপী) ছড়িয়ে রয়েছে এবং যাই এর মধ্য দিয়ে ’‘পা টেনে টেনে হেঁটে’ যায়Ñক্ষেত্রটি তাকেই নিজের দিকে টানে। কিছু কিছু কণিকার পক্ষে (অন্যদের তুলনায়) ক্ষেত্রটি অতিক্রম করা খুব সহজ হয় না, ফলে তারা হয় ভারিতর কণিকা। হিগসের মতে এমন ক্ষেত্র, পরবর্তীকালে ক্ষেত্রটির নামকরণ হয় হিগস ফিল্ড বা ক্ষেত্রÑযদি বাস্তবিকই থেকে থাকে, তবে ক্ষেত্রটির সঙ্গে জড়িত একটি কণিকা : হিগস-বোসন, থাকতেই হবে। কারণ পদার্থবিদ্যা বলছে যে যখনই কণিকারা ক্ষেত্রের (যে কোন ক্ষেত্রের) সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়া (ইন্টার্যাকশন) ঘটায়, মিথষ্ক্রিয়াটি সব সময়ই কণিকার মধ্যস্থতায় ঘটে থাকে। যেমন : তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রে আলোর কণিকা ফোটন মধ্যস্থতার দায়িত্ব পালন করে।
তবে হিগস-ক্ষেত্র করে কি?
অ-নে-ক অ-নে-ক অসংখ্য হিগস-কণিকা একত্রে ঝাড় বেঁধে তৈরি করে হিগস-ক্ষেত্রের, আর বিনিময়ে ক্ষেত্রটি থেকে হিগস-কণিকারা ভর পেয়ে থাকে। হিগস-ক্ষেত্র যদি না থাকত তো কি হতো? র্অথাৎ বিশ্বব্রহ্মা-ের হাল কি হতো? হতো এই যে বিশ্বব্রহ্মা-ে অন্য কোন পরমাণুর অস্তিত্ব থাকত না। ফলে সে তখন প্রায় আলোর গতিবেগের কাছাকাছি গতিবেগ সম্পন্ন একক একটিমাত্র বিন্দু হয়ে হুস হুস করত। হিগস-ক্ষেত্র র্সবব্যাপী বলে কণিকারা সব সময়ই ক্ষেত্রটির মধ্য দিয়ে চলাচল করছে। তবে তফাত মাত্র যে কম ভরের কণিকাদের তুলনায় ভারিতর ভরের কণিকারা ক্ষেত্রটির সঙ্গে অধিকমাত্রায় মিথষ্ক্রিয়া ঘটাচ্ছে। আবার একই সাইজের দুটো কণিকার ভিন্ন ভিন্ন ভর হয় কেন’র ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে।
কিভাবে সন্ধান মিলল?
পিটার হিগস সেই কবে, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে-হিগস-কণিকার কথা বলেছেন। আর তার দেখা মিলল ২০১২ সালে! প্রধান কারণ ছিল প্রযুক্তিগত। তদুপরি হিগস-কণিকা অত্যন্ত অস্থির স্বভাবের এবং দ্রুত অতি দ্রুত ভেঙ্গে যেতে পটু, জন্ম হতে না হতেই ভেঙ্গে যায়, ক্ষণজীবী সে। সুইজারল্যান্ডের জেনিভা শহরের মাটির নিচে অবস্থিত ‘লার্জ হেড্রন কলাইডারে’ (র্বতমানে পরমাণু ভাঙ্গার পৃথিবীর বৃহত্তম যন্ত্র) প্রোটনকে ক্রমান্বয়ে উত্তেজিত (ত্বরণবৃদ্ধি) করে করে প্রায় আলোর গতিবেগের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয় এবং ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করা হয়। কমসে কম প্রতি দশ বিলিয়ন (একের পরে নয়টি শূন্য এক বিলিয়ন) সংঘর্ষে মাত্র একটি হিগস-কণিকার জন্ম হয়। কাজেই মাত্র একটি ‘ক্ষণজীবী’ হিগস জন্ম নিলে সরাসরি তাকে র্পযবেক্ষণের সময় মিলবে না। বিজ্ঞানীরা তাই সংঘর্ষ-উত্তর অবশিষ্টাংশের রেকর্ড নেন এবং ক্ষয়প্রাপ্ত হিগস থেকে কোন কোন কণিকার জন্ম হলো সেগুলোর বৈজ্ঞানিক হিসাব-নিকাশ করেন। আর তাতেই ধরা পড়ে যে ‘ইতোপূর্বে অনাবিষ্কৃৃত এক বোসন, যার ভর ১২৫ গিগাইলেকট্রনভোল্ট, আকারে প্রোটনের চেয়ে প্রায় ১২৫ গুণ বড়- হিগস-কণিকাই হবে।’ আসলেও হিগস-কণিকাই বটে!
নাম কেন ‘ঈশ্বর কণিকা’?
এই কণিকার এই নামই মিডিয়াকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে, পরিণত হয় ‘পিআর’ পরিচালনার মূল বিন্দুতে। হিগস-কণিকা ওরফে ‘ঈশ্বর-কণিকা’র ‘জনপ্রিয়তাকে’ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের বিপুল সাড়া জাগানো জনপ্রিয়তার সঙ্গে অনায়াসে তুলনা করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই-উন্মোচিত রহস্য জনসাধারণ কতটুকু বুঝেছে প্রধান বিষয় নয়, আসল কথা হলো যে এটুকু তারা বুঝতে পেরেছে যে (আপেক্ষিক তত্ত্বের অনুরূপ) সম্ভবত হিগস-কণিকা বিজ্ঞানে নতুন প্রভাত নিয়ে আসছে।
পদার্থবিদ লিয়োন লিডারম্যান ডিক টেরেসিকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৯৩ সালে ‘দি গড পার্র্টিকেল; ইফ ইউনিভার্স ইজ দি আনসার, হোয়াট ইজ দি কোয়েশ্চেন?’ নামক একটি বই লেখেন ও প্রকাশ করেন। যদি বিশ্বব্রহ্মা- কেবল শক্তি উপাদানে গঠিত হতো, তবে সে আলোর গতিবেগে বেগমান থাকত। কিন্তু বস্তু ও শক্তি-এই দুই উপাদানের সমন্বয়ে বিশ্বব্রহ্মা- গঠিত। এই বস্তুর কাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব হিগস-কণিকার বা অন্যভাবে, অতি-পারমাণবিক (সাবএ্যাটামিক) কণিকাদের পর্যাবৃত্ত বিন্যাস বা পিরিয়োডিক টেবল’-এ হিগস-কণিকার অবস্থান থেকে সুস্পষ্ট যে বিশ্বব্রহ্মা- বিষয়ে চূড়ান্ত উপলব্ধির চাবিকাঠি তার ওপরে ন্যস্ত হয়েছে, অথচ ‘সে কেবল পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়...’। তাই ‘হতাশাগ্রস্ত’ ত্যক্তবিরক্ত বিজ্ঞানীরা আসলে বলেন ‘গডড্যাম’ (দুত্তোরিছাই) কণিকা। পুস্তক প্রকাশক ‘গডড্যাম কণিকা...’য় আপত্তি করলে, ‘কণিকার’ ড্যাম অংশটি বাদ দেয়া হয়, থেকে যায় ‘গড’ অংশটি । ‘ঈশ্বর-কণিকা’ নামক নামের মাহাত্ম্য হিগস-কণিকাকে ‘সেলিব্রেটি’র আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। চলবে...
লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক