দক্ষিণ এশিয়ায় আইএস ও আকিস ছাড়াও আরও একটি শক্ত প্রতিপক্ষ হচ্ছে আহলে হাদিস ঐতিহ্যের অনুসারী লস্কর-ই-তায়েবা (লেট)। এরা সহিংস হামলার জন্য মূলত ভারত ও আফগানিস্তানকেই বেছে নিয়েছে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকায় এরা পাকিস্তানের দেওবন্দি গ্রুপের মতো নিজ দেশে কখনো হামলা করেনি। এমন কী লেট তাদের বিভিন্ন প্রকাশনায় পাকিস্তানের ওপর হামলাকারী অপর জঙ্গী সংগঠনগুলোকে প্রকাশ্যে নিন্দা জানায়। আল কায়েদা যেখানে কাশ্মিরসহ ভারতের মুসলিমদের এতোদিন দলে টানার বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেয়নি সেখানে লেট সহিংস হামলার জন্য শক্তি বৃদ্ধিতে এদেরই দলে টেনে নিয়েছে সবচেয়ে বেশি। এদেরকে নিয়েই ২০০৮ সালের নবেম্বরে ভারতের মুম্বাইয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিলো লেট।
দক্ষিণ এশিয়া এভাবেই বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হয়েছে। উগ্র মৌলবাদী জঙ্গী সংগঠন দি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এ্যান্ড সিরিয়া (আইএসআইএস) বা আইএস আগামী ৫ বছরের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার পাশাপাশি বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা করেছে। বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা খেলাফত শাসন জারির পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ২০২০ সালের মধ্যে কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চল দখল করে নেবে তা একটি মানচিত্রের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছে সংগঠনটি। ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার নামে হাজার হাজার ভিন্ন ধর্ম ও মুক্তমনাদের নৃশংসভাবে হত্যা করে ইতোমধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এই ধর্মান্ধ উগ্র সংগঠনটি।
প্রভাবশালী গণমাধ্যম মিরর-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএসের পরিকল্পনা মানচিত্র অনুসারে আগামী ৫ বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালের মধ্যে ইউরোপীয় দেশ পশ্চিমের স্পেন থেকে শুরু করে পূর্বের চীন পর্যন্ত যে কোনভাবে আধিপত্য বিস্তার করা হবে। মানচিত্র অনুসারে স্পেন, পর্তুগাল ও ফ্রান্সকে আরবী নাম আন্দুলাস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অস্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত ওই তিনদেশের অঞ্চল বিশেষ আন্দুলাস নামে মুরদের শাসন ব্যবস্থায় পরিচালিত হতো। ভারতীয় উপমহাদেশ মানচিত্রে চিহ্নিত হয়েছে খোরাসান নামে।
২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি আইএসের মুখপাত্র আবু মোহাম্মদ আল আদনানি খোরাসান রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বেশিরভাগ এলাকা এবং ভারত ও চীনের বেশ কিছু অংশ এই খোরাসানে গুরুত্ব পাচ্ছে। এর সীমানা এখনও নির্দিষ্ট করা না হলেও ধারণা করা যাচ্ছে, ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশের প্রদেশগুলোকে নিয়ে আইএস কৌশল ঠিক করছে। কারণ ডুরান্ড লাইনের উভয় পাশেই সুন্নি উপজাতিগুলো বাস করে। সেখানের পাহাড়ী এলাকাগুলি জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর কাছে খুবই নিরাপদ স্থান। আইএস নতুন কৌশল হিসাবে সুন্নি জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মতভেদ দূর করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গী সংগঠনগুলোকে একত্রিত করে শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে। কারণ আইএসের চুলচেরা বিশ্লেষণে বার বার উঠে আসছে যে, আল কায়েদা ও তালেবানের মতো জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো প্রায় চার দশক ধরে ভয়াবহ সব হামলার ঘটনা ঘটালেও খেলাফত প্রতিষ্ঠা বা ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেনি। তাই একতা প্রয়োজন সবার আগে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু জঙ্গী সংগঠন আইএসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশও করেছে। পাকিস্তানের পেশাওয়ারে সেনা স্কুলে হামলা চালিয়ে শত শত শিশু হত্যাকারী তেহরিক তালেবান অব পাকিস্তানের (টিটিপি) মুখপাত্র শেখ মকবুল ২০১৩ সালে আইএসের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আইএস টিটিপির আবেদন মঞ্জুর করে। তালেবানদের উপরের স্তরের অনেক নেতা ২০১৩ সাল থেকেই তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের নেতৃত্ব থেকে সরে এসে আইএস প্রধান বাগদাদীর প্রতি সমর্থণ দিয়েছে। খোরাসানের উপরের স্তরের ১২টি পদে নিয়োগ দেয়া হয় টিটিপি নেতাদের। আইএস পাকিস্তানী তালেবান নেতা হাফিজ সাইদ খানকে খোরাসানের প্রধান এবং মোল্লা আবদুল রউফ খাদিমকে তার ডেপুটি ঘোষণা করে আইএস। রউফের নেতৃত্বে আফগানভিত্তিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা, সদস্য সংগ্রহ, কৌশল নির্ধারণসহ অন্যান্য বিষয়গুলোর বিস্তৃতি ঘটানো হতো। তবে গত ৯ ফেব্রুয়ারি ন্যাটোর ড্রোন হামলায় নিহত হন রউফ। এরপর ৬ আগস্ট খোরাসানের আফগান অংশের আইএস আমির গুল জামান মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হন। বিবিসির প্রতিবেদক এ্যান্ড্রু হসকেন তার নতুন বই ‘ ভয়ের সাম্রাজ্য: ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে’ শীর্ষক বইয়ে আইএসআইএসের লক্ষ্য ও মানচিত্র অন্তর্ভুক্ত করে বলেছেন, সংগঠনটি ইসলামী শাসন কায়েমের নামে পুরো বিশ্ব দখলে নিতে চায়। তারা বিশ্বকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। সাতটি ধাপে আইএসআইএস তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করেছে। যা প্রায় ২০ বছর আগে ১৯৯৬ সাল ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার মনোভাবের ভিত্তিতে করা হয়েছে। আইএসআইএসের প্রতিষ্ঠাতা আবু মুসাব আল-জারকাওয়ির স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে জয় ছিনিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে তৈরি হয়েছে সাত ধাপের পরিকল্পনা বা কর্মসূচী। ২০০০ এবং ২০০৩ সালের মধ্যে ইরাকসহ কয়েকটি মুসলিম দেশ এবং ২০১০ ও ২০১৩ সালের মধ্যে কয়েকজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ঘোষণার বিষয়টিও ওই কর্মসূচী বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অনুমান করা হয়, আইএসের ৫০ থেকে ৮০ হাজার সদস্য রয়েছে। সংগঠনটির নগদ অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন পাউন্ড। ইরাক ও সিরিয়ার তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রের ওপর রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও আইএসআইএসের কাছে দুটোই চরম শত্রু রাষ্ট্র। এমন ৬০টি দেশকে তারা বিরোধী বা চরম শত্রু রাষ্ট্র হিসাবে চিহ্নিত করেছে। হসকেন তার বইয়ে আরও বলেছেন, আইএসআইএসের ৮০ শতাংশ নেতাকে আটক বা হত্যার মধ্য দিয়ে একটি খ-ের মাত্র সমাপ্তি টানা হয়েছে। তাদের পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। তারা ফিরে এসেছে ক্যান্সারের মতো।