মোহাম্মদ আল কিরাফাবি। পেশায় তিনি একজন ফেরিওয়ালা। ৩৮ বছর বয়সী কিরাফাবির প্রতিদিন ব্যবসার জন্য আইএসের চেকপোস্ট পার হতে হয়। আর চেকপোস্ট পার হতে গেলেই অর্থ দিতে হয় আইএসকে। তাদের দাবি অনুযায়ী অর্থ না দিলে তার ট্রাকগুলো আবার উল্টোপথে ফেরত পাঠাবে অথবা তাকে আটক করবে। তিনি ইসলামিক স্টেটের (আইএস) যোদ্ধাদের প্রতি মাসে গড়ে ৯শ’ ডলার দেন। স্বেচ্ছায় নয় বাধ্যতামূলকভাবে তিনি এ অর্থ প্রদান করেন। তিনি জর্দান থেকে আইসক্রিম এনে ইরাকের আইএস নিয়ন্ত্রিত অংশে বিক্রি করেন। ইন্টারন্যাশনাল হেলাল্ড ট্রিবিউন, দ্য হিন্দু, ডেইলি মেইলের বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনায় উঠে এসেছে আইএস কিভাবে অর্থ উপার্জন করে, কারাই বা দেয় সে অর্থ।
সিরিয়ার রাকানগরী, যেটি এখন আইএসের ডি ফ্যাক্টো রাজধানী সেখানে তারা সম্প্রতি মার্কেটগুলোর ওপর পরিচ্ছন্ন কর বসিয়েছে। দোকানের সাইজ অনুযায়ী ৭ থেকে ১৪ ডলার করে দিতে হবে। এছাড়া কর বসানো হয়েছে পানি ও বিদ্যুতের ওপরও। এভাবে বার্ষিক প্রায় ৩০ হাজার ডলার আয় হবে। এছাড়া আইএসের ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর কর বসিয়েছে। গাড়ি নিবন্ধন এমনকি ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবইয়ের ওপরও তারা শুল্ক বসিয়েছে। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে জরিমানা আদায় করতেই আইএস বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে।
জর্দান থেকে ইরাকে ঢুকলে আমদানি শুল্ক বাবদ আইএসকে নগদ অর্থ প্রদান করতে হয়। অবশ্য আইএসের জঙ্গীরা মনে করে না যে, তারা ঘুষ বা দক্ষিণা হিসেবে কারও কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে। প্রাপ্ত অর্থের স্বীকৃতিস্বরূপ তারা নিজেদের সরকারী সিলযুক্ত রসিদও দিয়ে থাকে। ইরাক ও সিরিয়ার বড় একটি অংশজুড়ে আইএস নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই অঞ্চলে বসবাসকারী বা এখান দিয়ে অতিক্রমকারী সবাইকে অর্থের যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহার করছে আইএস। নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আমেরিকান ডলার, ইরাকী দিনার বা সিরিয়ান পাউন্ড যার কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই আদায় করে নিচ্ছে। আইএস সড়ক পথে যাতায়াতকারীদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করছে, সরকারী ভবনগুলো থেকে ভাড়া আদায় করছে, পানি ও বিদ্যুতের মতো পরিষেবা খাতে অর্থ আদায় করছে। ধূমপান বা তাদের বেঁধে দেয়া পোশাক বিধির বাইরে কাপড় পরিধান করলে জরিমানা আদায় করে ছাড়ছে। ধারণা হচ্ছে, আইএসের বার্ষিক আদায় প্রায় ১০০ কোটি ডলার। ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন ইউনিভর্সিটির সন্ত্রাস, আন্তর্জাতিক অপরাধ ও দুর্নীতিবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক লুইস শেলি বলেন, ‘তারা (আইএস) সকালে যুদ্ধ করে আর বিকেলে কর আদায় করে’।
আইএসের রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎসগুলো হলো- তেল পাচার, ব্যাংকের ভল্ট লুট করা, পুরাকীর্তি লুণ্ঠন ও বিদেশীদের পণবন্দী করে মুক্তিপণ আদায় করা। এছাড়া তেলসমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর অঞ্চলের ধনীদের দান-দক্ষিণা আইএসের আয়ের আরেকটি বড় উৎস। নবেম্বরের শেষের দিকে সিরিয়ায় মার্কিন বিমানবাহিনী তেল বহনকারী আইএসের ১১৬টি যান ধ্বংস করেছে। এসব সত্ত্বেও আইএসের আর্থিক অবস্থা যে ভেঙ্গে পড়েছে তা মনে করার কোন উপায় নেই। র্যান্ড কর্পোরেশনের সন্ত্রাস বিশেষজ্ঞ সেথ জোন্সের মতে, আর্থিকভাবে তাদের চেপে ধরতে হলে রাজস্ব আদায়ের উৎস বন্ধ করে দিতে হবে। তারা সেসব জায়গা নিজেদের দখলে রেখেছে সেই ভূখ-গুলোই তাদের রাজস্ব আয়ের উৎস।
ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় মসুলের পূর্বদিকে দজলা নদীর ওপারে বাব আল তুব এলাকায় অটোমান আমলে নির্মিত একটি পুলিশ চৌকিকে এখন মার্কেট বানিয়েছে আইএস। চৌকিটি ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে নির্মিত। ৬০টি স্টল করে সেখানে এখন ফল ও শাক-সবজির বাজার বসানো হয়েছে। দোকানগুলো বার্ষিক ভাড়া প্রায় আড়াই হাজার ডলারের মতো। এসব তথ্য পাওয়া গেছে যোগাযোগ নেটওয়ার্কে আড়িপেতে এবং দলছুট আইএস সদস্যদের কাছ থেকে। আইএস নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার জটিল অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের পুরো চিত্রটি পাওয়া বেশ কঠিন।
আইএসের যত অর্থ
এক সময় আইএসের অর্থের মূল যোগানদাতা ছিলেন উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর ধনীদাতারা। তবে সংগঠনটির জঙ্গী তৎপরতার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী আলোচিত হলে তাঁদের অনেকেই সহায়তা বন্ধ করে দেন। তখন সংগঠনটি তেলভিত্তিক আয়ের উৎস গড়ে তোলে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মতে, সারাবিশ্বের ৪০টি দেশ থেকে জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) অর্থ পাচ্ছে। এই দেশগুলোর মধ্যে জি-২০ভুক্ত দেশও রয়েছে।
অস্ত্র ও যানবাহন কেনা, দলের সদস্যদের খরচাপাতি, প্রচারণামূলক ভিডিও এবং কর্মীদের একস্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠাতে আইএসের অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়। বর্তমানে যত জঙ্গীগোষ্ঠী আছে, এর মধ্যে আইএস সবচেয়ে ধনী।
ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০০৮ সালের শেষের দিকে আইএস প্রতি মাসে ১০ লাখ ডলার আয় করত। ২০০৯ সালে প্রথম দিক থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই আয় দৈনিক ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছায়। পত্রিকাটি আইএসের অর্থ উপার্জনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। সেগুলো হচ্ছেÑ
কর ও চাঁদাবাজি
দিন দিন আইএস নিয়ন্ত্রণ অঞ্চলের আয়তন বাড়ছে। এসব অঞ্চলে যারা বাস করে, তাদের ওপর করারোপ করে আইএস। আয়ের আরেকটি উপায় ছিল চাঁদাবাজি। পণ্য বিক্রি, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি, ব্যাংকের হিসাব থেকে নগদ টাকা তোলা, বিভিন্ন কর্মচারীর বেতন, নিয়ন্ত্রিত এলাকার তল্লাশি চৌকি দিয়ে ট্রাক ঢুকলে, বিদ্যুত ও পানি ব্যবহারের জন্য আইএসকে কর দিতে হয়। ব্যবহারকারীরা অবশ্য দিনে মাত্র এক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুত পান। সিরিয়ার বিখ্যাত প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন চুরি করে বিক্রি করা এবং অমুসলিমদের কাছ থেকে চাঁদা ও লুটপাট করে বেশ ভালই আয় করে এই জঙ্গী সংগঠনটি। সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে জানানো হয়, এভাবে আইএস বছরে প্রায় ৩৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিজেদের পকেটে পুরেছে। যারা আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকা দিয়ে যাতায়াত করে, সেখানে ব্যবসা করে এবং বসবাস করে তাদের ‘নিরাপত্তা’ দেয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে চাঁদা আদায় করে আইএস। আইএস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় দুই ধরনের নিয়ম চালু আছে। যারা আইএস যোদ্ধা, তাদের পরিবার চিকিৎসাসহ অন্যান্য খাতে বিনামূল্যে সেবা পায়। এর বাইরের যারা থাকে, তাদের কর দিয়েই থাকতে হয়।
ইরাকে ব্যাংক লুট
মার্কিন অর্থ বিভাগের হিসাবে, ২০১৪ সালে ইরাকের উত্তর ও পশ্চিম দিকে কয়েকটি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ব্যাংকের শাখায় ডাকাতি করে আইএস পাঁচ লাখ ডলার অর্থ নিজের তহবিলের জমা করে।
লুটের পণ্য বিক্রি
মার্কিন অর্থ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, আইএস ইরাকে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় মার্কিন যানবাহন ও অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ আয় করে। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী, বৈদ্যুতিক তার, আসবাবপত্র বিক্রি, আবাসন খাত, কৃষি খাত, মানবপাচার ও বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পণ্য বিক্রি করে অর্থ আয় করে আইএস।
অপহরণ ও মুক্তিপণ
বিভিন্ন বিদেশী নাগরিকদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় এই জঙ্গীগোষ্ঠীটির আয়ের অন্যতম একটি বড় উৎস। জাতিসংঘের ২০১৪ সালের অক্টোবরে এক হিসাবে বলেছে, আইএস ২০১৪ সালে অপহরণের পর মুক্তিপণের মাধ্যমে তিন কোটি ৫০ লাখ ডলার থেকে চার কোটি ৫০ লাখ ডলার আয় করে।
বিত্তশালী দাতা
আইএসের আয়ের অন্যতম উৎস ধনীদাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া অর্থ। আইএস প্রাথমিকভাবে ধনীদাতাদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে অর্থ পেয়ে থাকে। সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত ও সংযুক্ত আবর আমিরাতের বড়লোক ব্যবসায়ীরা এই জঙ্গী সংগঠনে অর্থ দান করে। কোন কোন হিসাবে বলা হয়ে, এসব দেশের ধনী ব্যবসায়ীরা ২০১৩-১৪ সালে প্রায় চার কোটি ডলার আইএসকে দান করেন। খবরে বলা হচ্ছে, সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ সরকার এবং ইরানের ভয় থেকে মুক্তি পেতে ধনী ও বিত্তশালীরা আইএসের তহবিলে অর্থ দান করেন।
প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি
বিশ্বের কয়েকটি দেশের মধ্যে সিরিয়াও প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনের জন্য বিখ্যাত। এগুলো চুরি করে বিক্রি করে বহু অর্থ নিজেদের তহবিলে জমা করে। সিরিয়ার ঐতিহ্যবাহী শহর পালমিরার মতো অন্য শহরের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বিক্রি করাও আইএসের অর্থের একটি উৎস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রি করে আইএস বছরে ১০ কোটি ডলার আয় করে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ম্যাথু লেভিড ২০১৪ সালের নবেম্বর বলেছিলেন, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বিক্রির মাধ্যমে আইএস প্রচুর অর্থ আয় করে। এটা তাদের আয়ের দ্বিতীয় উৎস।
তেল
ইরাক ও সিরিয়ায় দখল করা তেলকূপগুলো এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আয়ের অন্যতম উৎস। এসব কূপ থেকে তেল তুলে তারা কালোবাজারে বিক্রি করে। এই বিকিকিনি চলে তুরস্ক সীমান্তে। তেল কিনতে সেখানে আগে থেকে অপেক্ষায় থাকে কিছু ব্যবসায়ী। যেহেতু এগুলো চুরি বা অবৈধভাবে তোলা হয়, তাই দামেও বেশ কম। এসব তেল পরে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে বা বিক্রি হয়। যোগাযোগের জন্য হোয়াটসএ্যাপ ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা। এভাবে তেল বিক্রি করে বেশ ভালই অর্থ পায় আইএস।