পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও অস্থির রাজনৈতিক মেরুকরণে আজ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে অধিক হারে জঙ্গীবাদ জন্ম নিচ্ছে। তবে ধারণা করা হয়, যেসব দেশের জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এশিয়া ও আফ্রিকায় তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। জঙ্গীবাদের থাবায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। মূলত উগ্রবাদ থেকেই বীজ অঙ্কুরিত হয় জটিঙ্গবাদের। আইএস, আল কায়েদাসহ জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম এখন বহুধা ধারায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দেশে দেশে। বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়।
আইএস তাদের মতাদর্শ ও কার্যক্রম এদেশেও কার্যকর করতে চায়। জঙ্গীবাদের সদস্য নিয়োগ, প্রশিক্ষণসহ জেহাদি কর্মকা- সম্প্রসারিত হচ্ছে মানুষকে অসহিষ্ণু করে ফেলেÑ এ অজুহাতে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ এদের প্রবল বিরোধী।
দেশে জঙ্গীবাদের রাজনীতির ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কিছু উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ১৯৮০ সাল থেকে তাদের কর্মকা- প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রবিশ্যে চালিয়ে যেতে শুরু করে। ২০১১ সালে মোহাম্মদ আজিজুর রহমান এবং মোহাম্মদ বিন কাসেম একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমরা ঢাকাবাসী’ ও ‘খতমে নবুয়ত আন্দোলন’ (এই সংগঠন পাকিস্তানের অংশ ১৯৮০ সাল থেকে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
সুইডেনের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বারটিন লিন্টনার ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন ১৯৮০ সালের প্রথম দিকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা তাদের একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন রোহিঙ্গা প্যাট্রয়োকি ফ্রন্ট ভেঙ্গে মোহাম্মদ ইউসুফের (আরকান) নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন নামে একটি জঙ্গী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জামায়াত ইসলাম, আপগানিস্তানের গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের হিজবি-ই-ইসলাম, কাশ্মীরের হিজবুল-মুজাহিদিনসহ বহু জঙ্গী সংগঠন থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা পেয়ে আসছে।
১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চলতে থাকা যুদ্ধে অংশ নিতে দেশ থেকে অনেক বাংলাদেশী মুজাহিদিন আফগানিস্তানে গিয়েছিল। সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে এরা সশস্ত্র প্রশিক্ষণে পারদর্শী হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ সমাপ্তি হলে এসব মুজাহিদিন দেশে ফিরে আসে এবং বাংলাদেশে একটি শরিয়াভত্তিক ইসলামিক রাষ্ট্র রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে। সুইডিশ সাংবাদিক লিন্টনার তার প্রতিবেদনে সরাসরি উল্লেখ করেছেন, তখনকার ডানপন্থী রাজনীতির আদর্শিক বন্ধু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আফগানিস্তান ফেরত এসব বাংলাদেশী মুজাহিদিনদের প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছিল। জিয়াউর রহমানের এই মদদ দেয়ার নেপথ্যে কাজ করছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত বলয়ের বিরোধী শক্তি আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভাল করা।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এ দেশে মুজাহিদিনদের জঙ্গীবাদ কার্যক্রম শুরু হলেও এরশাদ শাসনামলে তারা স্তিমিত হয়ে যায়। এ সময় এরশাদবিরোধী কার্যক্রমে দেশের প্রধান দুই দল সোচ্চার ছিল। দুই দলের সঙ্গে দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোও সমন্বয় সাধন করেছিল যার ফলে জঙ্গীবাদ কার্যক্রম তেমন একটা দানা বেধে উঠতে দেখা যায়নি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ১৯৭৫ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সময়কালকে দেশে জঙ্গীবাদের ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে উল্লেখ করছেন। তবে এসব হিসাব-নিকাশকে পেছনে ফেলে দিয়ে ২০০১ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জঙ্গীবাদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। দেশব্যাপী ৩৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনায় বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ আলোচনায় চলে আসে। বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে সরকার গঠন করলে ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ব্যাপকভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও আনুকূল্যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তার শেকড় ছড়িয়ে দেয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সময় সরকারী তরফ থেকে জঙ্গীবাদকে নানাভাবে সহযোগিতা করা হয়। সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে সে সময় জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো দেশব্যাপী অবাধে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যেতে থাকে। এ সময় যে চারটি জঙ্গী সংগঠন নানাভাবে তৎপর ছিল তা হলো জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদুল ইসলামী ও হিজবুত তওহিদ। সে সময় দেশের জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান ও দেশী বিদেশী গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। মূলত বিএনপি-জামায়াতের কারণে সে সময় জঙ্গীবাদের ব্যাপক উত্থান ঘটেছিল। এই সময়ে উত্থান ঘটে কুখ্যাত বাংলা ভাই ও আবদুর রহমানের। পরবর্তীতে যাদের ফাঁসিতেই মৃত্যুবরণ করতে হয়। অব্যাহত জঙ্গী হামলায় দেশের মানুষ এর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছিল। অনেকটা দায়ে পড়ে বা নিজেদের গা-বাঁচানোর জন্য ২০০৫ সালের শেষের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বাংলা ভাইসহ কয়েকজন জঙ্গী নেতার ফাঁসি কার্যকর করেছিল। সে সময় বিএনপি-জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করার অভিযোগ ওঠে।
দেশে প্রায় ৭০টি জঙ্গী সংগঠন তৎপর রয়েছে। কৌশলগত কারণে জঙ্গী সংগঠনগুলো কখনও কখনও তাদের চেহারা বদলায়, নাম বদলায়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একই অবস্থানে রয়ে যায়। একটি বেসরকারী গবেষণায় জানা যায়, দেশে ১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৯ থেকে ৪ নবেম্বর ২০১০ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় বোমা হামলায় ১৩৬ জন নিহত ও ২ হাজার ৪৮৮ জন আহত হয়েছেন।
জানা যায়, ১৯৯৯ সালের ৭ মার্চ যশোরে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর ওপর জঙ্গীরা বোমা হামলা করে। এই ঘটনায় ১৯ জন মারা যায়। আহত হয়েছেন ১০৬ জন। একই বছরের ৮ অক্টোবর খুলনায় আহমদিয়াদের মসজিদে বোমা হামলায় ৮ জন মারা যায় আহত হয় ৪০ জন। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিলে রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানের বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও একশ’রও বেশি আহত হয়েছেন। ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরাতে শক্তিশালী দুটি বোমা হামলায় ৩ জন মারা যায় আহত হয় ১২৫ জনেরও বেশি। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর সিরিয়াল বোমা হামলা চালানো হয় ময়মনসিংহের সিনেমা হলগুলোতে এতে ১৮ জন মারা যায়। আহত হয় ৩০০। ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জের দনিয়ায় এক মেলাতে বোমা হামলা চালিয়ে ৮ জনকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ১২ জানুয়ারি সিলেটের হযরত শাহ জালাল দরগার শরীফে এক বোমা হামলায় ১০ জন নিহত ও আহত হয় ১৩৮ জন। ২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা করা হয় এতে তিনি রক্ষা পেলেও ২ জন মারা যান। একই বছরের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত সিরিয়াল গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গী গোষ্ঠীরা এতে ২৩ জন নিহত হয় আহত হয় পাঁচ শতাধিক। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি বগুড়া ও নাটোরে বোমা হামলায় ৩ জন মারা যায়। আহত হয় ৭০। একই মাসে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এসএম কিবরিয়াসহ ৫ জন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গীরা সারাদেশে একযোগে সব জেলায় বোমা হামলা চালায়। একই বছরের ১৪ নবেম্বর ঝালকাঠিতে দু’জন সহকারী জেলা জজকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। ২৯ নবেম্বর চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলে এক সঙ্গে বোমা হামলা চালানো হয়। এই হামলায় ৮ জন নিহত হয়। ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ের সামনে বোমা হামলায় ৮ জন নিহত হয়। আহত ৪৮। জঙ্গীদের ধারাবাহিক বোমা হামলায় ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বোমা হামলায় এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ৩৭। বিএনপি জামায়াত জোটের সময় অর্থাৎ ২০০৩ সারের সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, সে সময় জেএমবি, হিজবুত তাহরির, হরকত-উল জিহাদ উল ইসলাম (হুজি) ও ইসলামিক বিপ্লবী পরিষদকে নিষিদ্ধ করার জন্য তৎকালীন সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়। কিন্তু সে পরামর্শ সরকার আমলে নেননি। অধিকন্তু জঙ্গী সংগঠনগুলোর ব্যাপারে উদার নীতি গ্রহণ করা হয়। ফলস্বরূপ দেশের মানুষ জঙ্গীবাদের উত্থান প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
সরকার পরিবর্তনের পর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জঙ্গীবাদের লাগাম টেনে ধরার কৌশল গ্রহণ করে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে এ সময় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি জামায়াতের প্রত্যক্ষ মদদে জঙ্গীরা দেশব্যাপী কায়েম করে পেট্রোল সন্ত্রাসের। এ সময় জঙ্গীরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে আত্মপ্রকাশ করে। সংগঠনটি বাংলাদেশ থেকে আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশের মানুষরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কিংবা উগ্রবাদ তথা জঙ্গীবাদের রাজনীতিতে থেকে শত-সহস্র মাইল দূরত্বে অবস্থান করবেÑ এরকম বিশ্বাস সকল মহলের।
দেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো আরও কঠোর রূপ নিয়ে মাঠে নামে। এ বিষয়ে জঙ্গীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়, মানসিক আশ্বাস জোগায় বিএনপি জামায়াত। ২০১৩ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে তৈরি হয় গণজাগরণ মঞ্চ। মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সকল পক্ষ একত্রিত হয়ে রাজাকার-আলবদর-আল শামসদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এতে করে জঙ্গীরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্তদের ব্যাপারে। এরই ধারাবাহিকতায় জঙ্গীদের হাতে একের পর এক ব্লগার, মুক্তমনারা খুন হতে থাকেন। এসব খুনের ঘটনা সংঘটিত হবার পর জঙ্গী গ্রুপগুলো তার দায়ভার স্বীকার করে গণমাধ্যমে সেই কৃতিত্ব জাহিরও করে। প্রগতিশীল চিন্তাধারার বিশিষ্ট লেখক, চিন্তাবিদ, গবেষক, সাংবাদিক, অধ্যাপকসহ বিভিন্ন মানুষজনদের তারা চিঠিও টেলিফোনে জীবননামের হুমকি দিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও এর ধারাকে ব্যাহত করতে চায়।