ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা অভিযান এবং মার্কিন আক্রমণ

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৫

আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা অভিযান এবং মার্কিন আক্রমণ

১৯৭৩ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে ছিল বাদশাহ জহির শাহের সামান্ততান্ত্রিক শাসন। সামান্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্রটি উৎখাত করেন বাদশাহ জহির শাহের ভগ্নিপতি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধান জেনারেল দাউদ। তিনি আফগানিস্তানকে রিপাবলিক ঘোষণা করেন। বিলুপ্ত হলো রাজতন্ত্র। জেনারেল দাউদ অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু তার একটিও বাস্তবায়ন করেননি। বদল ঘটল শুধু বাদশাহ জহির শাহের পরিবর্তে শাসনকর্তা হলেন জেনারেল দাউদ। ফলে রিপাবলিকের সমর্থক গণসংগঠন, বুদ্ধিজীবী মহল, এমন কী সেনাবাহিনীর অফিসারদের অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে আকস্মিক এক অভ্যুত্থানে জেনারেল দাউদ হলেন পদচ্যুত এবং নূর মোহাম্মদ তারাকির নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী পরিষদ ক্ষমতা দখল করে। বুদ্ধিজীবী, শ্রমিক সংগঠন ও সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠন করা হয় এই বিপ্লবী পরিষদ। এই ক্ষমতা দখলকে বলা হতো সাউর বিপ্লব। সাউর আফগান ক্যালেন্ডারে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়কে বলা হয়। এই সময়টা আমাদের বৈশাখ মাসের শুরুর সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। বিপ্লবী পরিষদের নেতৃত্বে ছিল পিপলস্ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। এই পার্টি আবার অলিখিতভাবে দুটি অংশে বিভক্ত ছিল- একটি পারচাম (পতাকা) এবং অন্যটি খাল্ক (জনগণ)। নিজেদের মতপার্থক্য ও বিভেদ সাময়িক অবদমিত করে তারা ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু কিছু কালের মধ্যেই তাদের বিরোধী মতপার্থক্য এমন পর্যায়ে যায় যে, দেশের উপপ্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দলের মহাসচিব হাফিজুল্লা আমিন (১৯৮০) ক্ষমতা দখল করে বসেন। শুধু তাই নয় প্রেসিডেন্ট তারাকিকেও হত্যা করা হয়। এটা ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসের ঘটনা। আর হাফিজুল্লা আমিন ডিসেম্বরেই পদচ্যুত হন দলের সশস্ত্র অংশের হাতে। ক্ষমতাসীন হলেন পূর্ব ইউরোপের একটি দেশে নিযুক্ত আফগান রাষ্ট্রদূত বারবাক কারমাল। ক্ষমতা গ্রহণের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই (১৯৮০ সালের ২৮ ডিসেম্বর) সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে জরুরী সামরিক সহায়তা চান। সোভিয়েত ইউনিয়নও দ্রুতবেগে এই আহ্বানে সাড়া দেয়। এই প্রেক্ষাপটে পরাক্রমশালী পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তথা আফগানিস্তানের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আধুনিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের বিরুদ্ধে চরম প্রতিক্রিয়াশীল মোল্লা আর উপজাতীয় সরদারদের ছোট ছোট আফগান বিদ্রোহী গ্রুপ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকে। পরবর্তীতে এদেরকে নিয়ে মুজাহিদীন বাহিনী গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক অবস্থায় সৌদি আরব, মিসর ও উপসাগরীয় দেশগুলো মুজাহিদিনদের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছিল। ওই সময় সুযোগটি গ্রহণ করে আমেরিকা। সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্বল করতে আফগান মুজাহিদিনদের সঙ্গে যুদ্ধ যেন দীর্ঘ হতে পারে সেজন্য মুজাহিদিনদের অস্ত্র সহায়তা দিতে শুরু করে আমেরিকা। চরম প্রতিক্রিয়াশীল মুজাহিদদের একমাত্র পুঁজি ছিল ইসলাম। ইসলাম রক্ষার নামে তারা জিহাদ চালু করে। তাদের উস্কে দিতে থাকে আমেরিকা। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ সহায়তার কারণে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অনেক সৈন্য মৃত্যুসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক ক্ষতি হজম করতে হয়েছিল আমেরিকাকে। ফলে মুজাহিদিনদের সাহায্য করার মাধ্যমে আমেরিকা প্রতিশোধ নিতে চাইছিল। ধর্মের বিষয়টি প্রাধান্য পাওয়ায় এই যুদ্ধকে ‘জিহাদ’ নাম দিয়ে আফগানদের অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে থাকে পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মুসলিমরা এ যুদ্ধে অংশ নিতে থাকে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আফগানিস্তানে আবির্ভাব ঘটে সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেনের। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে থাকায় ওসামা বিন লাদেনকে প্রচ-ভাবে সমর্থন দিতে শুরু করে আমেরিকা। আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তে মাদ্রাসা চালু করা হয়। মাদ্রাসার ছাত্রদের বলা হয় তালেব বা তালেবান। সেই মাদ্রাসার এক শিক্ষক মোহাম্মদ ওমর পরবর্তীতে তালেবান নেতা হন। এই ছাত্রদের পাহাড়ে ও সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ মদদে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আফগানিস্তানে পাঠানো হতো। আমেরিকা ওই সময় সবচেয়ে আধুনিক ‘স্টিংগার’ নামক এ্যান্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল তুলে দেয় আফগান মুজাহিদদের হাতে। পতন হতে থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের। দশ বছরের যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ঘটে বিশ্বজুড়ে। উত্থান ঘটতে থাকে মোল্লা ওমরের তালেবান রাষ্ট্রের। সঙ্গে আল কায়েদার। আফগান মুজাহিদদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দেয়। তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রদেশ শাসন শুরু করল। এই দুরাচার শাসনে অতিষ্ঠ বিভিন্ন গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। শুরু হলো গৃহযুদ্ধ। পাকিস্তান ও আমেরিকার সহায়তায় ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহারের নিয়ন্ত্রণ নেয়া মোল্লা ওমরের তালেবানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয় ওসামা বিন লাদেনের। তালেবানরা কাবুল দখল করে শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠা করে। আর লাদেন আল কায়েদা নামে নিজের একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলে। ওই সময় নারী অধিকার সম্পূর্ণভাবে শেষ করে ফেলা হয়। নারী হয়ে পড়ে গৃহবন্দী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটায় আমেরিকা সরে আসতে শুরু করে তালেবানদের সহায়তা করা থেকে। শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। লাদেন আমেরিকাকে মুসলমানদের শত্রু উল্লেখ করে কয়েকটি দেশে আমেরিকান দূতাবাসে হামলা শুরু করে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আল কায়েদা নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালিয়ে প্রায় ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে চাপ দেন লাদেনকে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু ওমর তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি ওই হামলা আল কায়েদার নয় বলে দাবি করেন। বিন লাদেনকে কেন্দ্র করে তালেবানদের সঙ্গে ২০০১ সালে ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু করে আমেরিকা। পতন হয় তালেবান শাসনের। আমেরিকার সমর্থন দিয়ে আফগানিস্তানে শুরু হয় হামিদ কারজাইয়ের শাসন। ওই সময় মোল্লা ওমর ও বিন লাদেন পালিয়ে যান। তবে পাহাড়ে ও পাকিস্তানে ছোট ছোট গ্রুপে তারা সংগঠিত হতে শুরু করে। ২০০৬ সাল থেকে ছোট ছোট হামলা চালানো শুরু করল আমেরিকার সামরিক বাহিনীর ওপর। পাঁচ বছর পর ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানে এ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে সামরিক অভিযানের মাধ্যমে হত্যা করে আমেরিকা। মোল্লা ওমরের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য। দুই বছর আগে তার মৃত্যুর ঘোষণা আসে। ইরাকে মার্কিন হামলা পরবর্তী সময়ে এই মহাদানবের জন্ম হয়। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার অভিযোগে ইরাকে সামরিক অভিযান চালায়। ৯ এপ্রিল মার্কিন বাহিনী বাগদাদ দখল করে সাদ্দামকে ক্ষমতাচ্যুত করে। একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর তাকে তার জন্মস্থান তিকরিত থেকে মার্কিন বাহিনী আটক করে। মানবতাবিরোধী অপরাধে তার বিচার করে আমেরিকা তার ফাঁসি কার্যকর করে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সাদ্দাম হোসেনের পতন ও হত্যার পর গড়ে ওঠে আইএস। সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য আইএসে যোগদান করে।
×