আইএসের বিস্তৃতি নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে নানা ধরনের আলোচনা, বিতর্ক, চুলচেরা বিশ্লেষণ। যুক্তি-পাল্টা যুক্তি। সবকিছু ছাপিয়ে যে আলোচনাটা সবার সামনে চলে আসে তা হলো আইএসের বিস্তৃতি লাভে রয়েছে এর কৌশল ও সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির দ্বন্দ্ব-অন্তর্দ্বন্দ্ব। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা আইএসের অগ্রযাত্রা তথা সম্প্রসারণকে বিশ্ব নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে একে নেতিবাচক হিসেবে দেখছেন। কোন কোন মহল আইএসের এই অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবেও দেখতে আগ্রহী। তবে রাজনীতির বিশ্লেষকরা আইএসের পুরো বিষয়টাকেই প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করছেন।
আইএস কিভাবে বিস্তৃতি লাভ করল- এরকম প্রশ্নের নানাবিধ উত্তর আছে। সরল সমীকরণ করলে দেখা যায় সিরিয়া গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সেই অঞ্চলে আইএসআইএসের অস্তিত্ব ছিল না। তাহলে কীভাবে এর সৃষ্টি হলো? সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদ (বাশার আল আসাদের বাবা) ১৯৯৩ সালে হামায় বিদ্রোহ নৃশংসভাবে দমন করার পর সিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। ২০১১ সালের আগস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর উদ্যোগ নেন। বিষয়টিকে তিনি মোটাদাগে চিত্রিত করে গণতন্ত্রের জন্য ‘পথ পরিষ্কার করার’ জন্য বাশারের প্রতি আহ্বান জানান। ঐ একই সময়ে বারাক ওবামার সঙ্গে গলা মেলান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঞ্জেলা মেরকেল এবং ফরাসী প্রেসিডেন্ট নিকোলা সারকোজি। তারা অভিন্ন কণ্ঠে বাশারের পদত্যাগের দাবিকে মূল ইস্যু বানিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে জটিল করে তোলেন। সে সময় জর্দানের বাদশাহ আবদুল্লাহসহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের শীর্ষ নেতারাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সিরিয়া বিদ্রোহ ক্রমান্বয়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে। সৌদি আরব বিদ্রোহীদের প্রত্যক্ষভাবে ব্যাপক সামরিক সাহায্য দিতে থাকে। আসাদ এবং সিরীয় বার্থপার্টির উঁচু স্তরের বেশ কয়েকজন নেতা ইসলাম শিয়াপন্থী হওয়াতে সৌদি আরব আগেই তাদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল।
সমস্যার শুরু সেখান থেকেই। আইএস মূলত কয়েকটি শক্তিশালী দেশ ও কতিপয় বিশ্ব নেতাদের প্ররোচণায় বাশারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বলে কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে বর্ষীয়ান সাংবাদিক প্যারিক ককবার্ন বেশ পরিচিত। তিনি তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ ‘দ্য রাইজ অব ইসলামিক স্টেট : আইএস আইএস এ্যান্ড দ্য নিউ সুন্নি রেভিউল্যুশন’তে বিষয়টিকে বেশ তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। ককবার্ন যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদপত্র দি ইনডিপেন্ডেন্টে পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতি ও সঙ্কট নিয়ে কাজ করছেন। তিনি তার গ্রন্থে আইএস আইএসের ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন পাশাপাশি সুন্নী সন্ত্রাসী গ্রুপটির ভয়াবহ আতঙ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার নেপথ্য কারণ শনাক্ত করেছেন। ককবার্ন তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন দুটি মারাত্মক সমস্যা ইরাককে আবারও সঙ্কটের মধ্যে ফেলেছে। ইরাকী নেতৃত্বের সম্প্রদায়িক পন্থা এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ। তিউনিসিয়া, মিসর ও লিবিয়ার মতো আরব দেশগুলোতে গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালের মার্চে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ফেটে পড়লে সিরিয়া সঙ্কটের সূচনা ঘটে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ বিক্ষোভ দমনে কঠোরতর ভূমিকা নিয়ে শত শত মানুষ হত্যা করে। সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। গৃহযুদ্ধের এই সুযোগকে কাজে লাগায় বহিরাগত শক্তিÑ বিশেষ করে সৌদি আরব। তাদের মূল লক্ষ্য হয়ে পড়ে সিরিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তেল। বিদ্রোহী শক্তিগুলোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে আইএস। আর আইএসকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোর কয়েকটি দেশ। আইএসের হয়ে বাশারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এসব দেশ।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ পঞ্চম বর্ষে পদার্পণ করলে আইএস তথা বিদ্রোহী বাহিনীকে এখনও বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবেলা করছে বাশার বাহিনী। ইরান এই অঞ্চলে সিরিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র। তেহরান ও লেবাননী শিয়া মিলিশিয়া-কাম-রাজনৈতিক আন্দোলন হিজবুল্লাহর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হলো সিরিয়া। সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলের বাইরে সিরিয়ার তার সঙ্গেই রয়েছে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটি। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অর্থ হলো ইরান ও রাশিয়াকে স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল করে ফেলা। সিরিয়াকে ধরাশায়ী করা গেলে নিশ্চিতভাবে পাশ্চাত্য ও সৌদি আরব লাভবান হবে। আইএস যোদ্ধারা যখন সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তখন সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা তথা বাশার বিরোধীদের হাতে নগদ অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিতে শুরু করে তা ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখে। জর্দান তার ভূখ-কে আইএসের প্রশিক্ষণ শিবিরের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। অন্যদিকে ইসলামী বিশ্বে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমিকায় ফিরতে থাকা তুরস্ক সিরিয়ার সঙ্গে তার ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তকে আইএসের যোদ্ধাদের সহজে আসা-যাওয়ার কাজে ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। পাশ্চাত্য শক্তিও আইএসের পাশে এসে ছায়ার মতো দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে ইরান ও রাশিয়া সিরিয়ার প্রতি তাদের নিঃশর্ত সমর্থনদানের বিষয়টি জাতিসংঘসহ সব জায়গাই পুনর্ব্যক্ত করে। যার ফলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে কেউই নিজেদের বিজয় দাবি করতে পারে না।
সিরিয়ায় আইএস তাদের শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শনের ব্যাপারে কৃতিত্ব দেখায়। আইএসের নেতা বাগদাদী বেশ উচ্চাকাক্সক্ষী। প্রখ্যাত সাংবাদিক ককবার্ন আইএস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, আল কায়েদাকে সংগঠনের চেয়ে একটি আইডিয়া বলাই ভালো। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখানে স্বেচ্ছায় ভর্তি হয় এবং যে কোন স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বাগদাদী চান একটি রাষ্ট্র নির্মাণ করতে যেটাকে তিনি বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র। ২০১৩ সালে সিরীয় নগরী রাক্কা দখল করার পর আইএস আবার ইরাকে প্রভাব বিস্তারের কাজ শুরু করে।
আইএসের উত্থান বিষয়ক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা বড় দাগে যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন কৃতিত্ব দিচ্ছেন আবার একই সঙ্গে দুষছেনও। যুক্তরাষ্ট্র্র দেশটির সম্প্রদায়গত বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে এই উদ্ভূত পরিস্থিতির সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করেছিল যার পেছনে উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের বাথ পার্টি নিষিদ্ধ করলে পরবর্তীতে এর লাখ লাখ যোদ্ধা ও বিপুলসংখ্যক জেনারেল বেকার হয়ে পড়ে। এরা সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান তাদের সামনে সশস্ত্র আন্দোলনের পথ খুলে দেয়। এদের বেশিরভাগই আল কায়েদা ধরনের সংগঠনে ভিড়ে যায়। এসব সুন্নি আধা সামরিক গ্রুপ ও উপজাতীয়দের মধ্যে বাথিস্ট নক্সবন্দী, আনসার আল ইসলাম, মুজাহিদিন আর্মি ইরাকে আইএস আইএসের অভিযানের সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
আফ্রিকার জঙ্গী সংগঠন বোকো হারামসহ কয়েকটি উগ্র গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আফ্রিকা জুড়ে হত্যা, নৃশংতা, ভিন্ন গোষ্ঠীর নারী ও শিশু অপহরণ ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার মতো জঘন্য অমানবিক কর্মকা-ে জড়িত। বোকো শব্দটি হাউসা ভাষার আর হারাম এসেছে আরবি থেকে। বোকো অর্থ পশ্চিমা শিক্ষা। বোকো হারাম মানে পশ্চিমা শিক্ষা পাপ। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম আল-কায়েদার মতো পশ্চিমা শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। আত্মঘাতী বোমা হামলা তাদের প্রধান যুদ্ধপদ্ধতি। আল কায়েদার মতো নিজস্ব মতবাদ বাস্তবায়নে চরমপন্থী। বোকো হারামের যোদ্ধারা প্রশিক্ষণের জন্য সোমালিয়া এমন কী আফগানিস্তান পর্যন্ত আসে। সংগঠরে মুখপাত্র আবু কাকা জানান, তারা যে কোন মূল্যে ইসলামী শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত করবেন। আল-কায়েদার ইসলামিক সদস্য, সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যের কিছু গোষ্ঠী বোকো হারামের তহবিল সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়া আল মুনতাদা ট্রাস্টও তহবিল জুগিয়ে থাকে। দেশটির খ্রিস্টান সম্প্রদায়েন ওপর একের পর এক হামলার জন্য দায়ী এই উগ্র সংগঠনটি। দেশটিতে ২০১২ সালে ৬২০ জন ও ২০১১ সালে ৪৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য জঙ্গী দলটিকে দায়ী করা হয়। বলা হয়, ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বোকো হারাম ৩ থেকে ১০ হাজার মানুষ হত্যা করেছে।