রহিম শেখ ॥ স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা অর্থনীতির দিক থেকে আত্মঘাতী হবে। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই অর্থনীতি টিকে থাকতে পারবে না। তার সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে না। ফলে জনসংখ্যার চাপে ক্ষুদ্র ভূখ-ে বাংলাদেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়বে। সবশেষে পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদরা ও তাদের পশ্চিমা দোসররা প্রচার করেন, বাংলাদেশের পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য ছাড়া আদৌ টিকে থাকা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার চার দশক পর সেই তথ্যটা বদলে গেছে। শুধু বদলেই যাইনি, রীতিমতো ‘উল্টে গেছে’। এখন পাকিস্তানী অর্থনীতিবিদরাই বলছেন ‘সত্যিই বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল’।
পশ্চিম পাকিস্তানকে এগিয়ে রাখার জন্য সেই দেশের শাসকরা যে বাংলাকে শোষণ করল, স্বাধীনতা যুদ্ধের চার দশক পর শুধু পাকিস্তানই নয়, বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে ভারতসহ অনেক নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত চার দশকে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে শূন্য থেকেও অনেক কিছু অর্জন করা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩১.২০ ডলার রফতানি আয় করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ওই বছরে পাকিস্তানে ২৪.১৮ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় আসে। কেবল রফতানি বাণিজ্যই নয়, দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতেও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি-নির্ভরতা অনেকটাই কমিয়েছে, যতটা পারেনি পাকিস্তান। শিল্পের কাঁচামালের জোগানদাতা ও আমদানি-বিকল্প শিল্প কারখানা বিকশিত হওয়ায় শিল্প খাতে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় কমছে। আবার খাদ্য উৎপাদন পাকিস্তান আমলের ৯৬ হাজার টন থেকে বেড়ে চার কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। ফলে খাদ্য আমদানি ব্যয়ও কমেছে। তাই রফতানি আয়ে পিছিয়ে থাকা পাকিস্তানের আমদানির পরিমাণও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। রফতানি আয়ে এগিয়ে থাকার পাশাপাশি আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ায় সামগ্রিক বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতিও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অনেক কম। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় খাত হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। সেদিক থেকেও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। এসব সূচকে এত দূর এগিয়ে থাকার প্রভাবটা আরও বেশি স্পষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশের ২৭ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান রিজার্ভ সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রিজার্ভের দিক দিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান, যা পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশী মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। সেই হিসাবে, পাকিস্তানের রিজার্ভ তার চেয়েও কম। অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতির কারণে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারও ছাড়িয়ে গেছে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধিকে। ক’বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। অন্যদিকে গত পাঁচ বছর ধরে পাকিস্তানের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে গড়াগড়ি করছে। অন্যান্য সূচকেও অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে মাথাপিছু সঞ্চয়ের হার প্রায় ২৮ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানের মাত্র ১৫ শতাংশ। সঞ্চয় কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই একটি দেশের জাতীয় মূলধন বিনিয়োগও কমে যায়। আর এভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার কমাটাও স্বাভাবিক। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম মিন্টু অস্ট্রেলিয়াতে অধ্যয়নকালীন বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিবর্তন সংক্রান্ত একটি গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন যেখানে ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে, সেখানে পাকিস্তানে ঘটেছে উল্টো ঘটনা। তারা কোথাও থেমে আছে, কোথাও বা পেছনে হেঁটেছে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান। আমাদের রফতানি বেড়েছে। তৈরি পোশাকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রফতানিকারক দেশ এখন বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন জাতির যে আকাক্ষা তার সবটুকু পূরণ না হলেও অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে শুধু পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
দেশীয় গবেষণা সংস্থার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসছে। লন্ডনের জাতীয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান লিখেছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধির বিচারে পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে। জেপি মরগান পাঁচটি অগ্রসরমান অর্থনীতির দেশের নাম উল্লেখ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ‘নেক্সট ইলেভেন’ সম্মিলিতভাবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ জনকণ্ঠকে বলেন, মাথাপিছু কম জমি নিয়ে আর কোনও দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নে এমন ইতিহাস সৃষ্টি করেনি। আমাদের বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমাগত বেশি করে সংযুক্ত হতে হবে। তিনি বলেন, গত ৪৪ বছরে রফতানি আয়ে বাংলাদেশের অর্জন সত্যিই বিস্ময়কর। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলারের রফতানি আয় গেল অর্থবছরে পৌঁছেছে প্রায় ৩ হাজার ২শ’ কোটি ডলারে। যে শিল্প পণ্যগুলো বহুমুখী করে রফতানি করব, সেগুলোর কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী পণ্য আমাদের আমদানি করতে হবে, এটাই এখন চ্যালেঞ্জ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, শূন্য থেকে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার গত ১০ বছর ধরেই ৬ শতাংশের ঘরে অবস্থান করছে। এই প্রবৃদ্ধি এবার ৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছবে। যেখানে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের ঘরে। গবর্নর বলেন, আমদানি-রফতানি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, রেমিটেন্স প্রবাহ, বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্যসহ সব সূচকেই উর্ধমুখী। আতিউর রহমান বলেন, কেবল প্রবৃদ্ধি নয়, বিশ্বমন্দার নেতিবাচক প্রভাব থেকেও মুক্ত থেকেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। গবর্নর বলেন, দেশী-বিদেশী নানা বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বিশ্বসমাজের নজর কেড়েছে। তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড স্ট্রিট জার্নাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারা থেকে পাকিস্তানকে শেখার পরামর্শ দিয়েছে। গত সোমবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়োজনে এক আন্তর্জাতিক কর্মশালা শেষে কথা হয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. এশরাত হুসেইনের সঙ্গে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। এটা প্রশংসনীয়। তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যে ‘বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল’ হতে পারে। সেই সঙ্গে তার দেশ পাকিস্তানও এগিয়ে যাচ্ছে বলে দেশটির এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন।
শুধু অর্থনীতি নয়, স্বাধীনতার চার দশকে সামাজিক সূচকেও পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। সম্প্রতি ‘বিশ্বব্যাংক গ্রুপ কনসালটেশনস, অক্টোবর-নভেম্বর, ২০১৫’- প্রতিবেদনে বলা হয়, গত চার দশকে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে শূন্য থেকেও অনেক কিছু অর্জন করা যায়। দেশটির মানব সূচক উন্নয়নে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিক্ষার সুযোগ এবং নারী-পুরুষ বৈষম্য নিরসনের মতো বিষয়গুলোতে আশাব্যঞ্জক উন্নতি করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীত হয়েছে যেখানে পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু ৬৫ বছর। পরিকল্পনা কমিশনের ‘সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার রোধেও পাকিস্তানের চেয়ে ভাল অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশে প্রতি হাজারে শিশুমৃত্যু হার (এক বছরের নিচে বয়স) ৩৭ জনের। অথচ পাকিস্তানে এ হার ৫৯। এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুমৃত্যু রোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য লক্ষণীয়। দেশে এখন পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যু হার হাজারে ৪৬ জন, যা পাকিস্তানে ৭২। স্যানিটেশনেও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছে। এখন দেশে ৫৬ শতাংশ পরিবার সঠিকভাবে স্যানিটেশন সুবিধা পায়। অথচ পাকিস্তানে এই হার ৪৮ শতাংশ। দেশে সন্তান জন্মের হারও অনেক কমেছে। ১৯৯০ সালে দেশে সন্তান জন্মের হার ছিল ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটি এখন কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশে, যা পাকিস্তানের চেয়েও কম। পাকিস্তানে এখন সন্তান জন্মের হার ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এম কে মুজেরি বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী চার দশকে বাংলাদেশের সামাজিক খাতের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম ছিল অনেক বেশি। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাত নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করেছে এসব সংস্থা। নারীর ক্ষমতায়নেও সরকারী-বেসরকারী সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করেছে। সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং বাজেটেও গুরুত্ব পেয়েছে এসব খাত। ফলে গত চার দশকে সামাজিক খাতের বেশ কিছু সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। আর এ বিষয়গুলোই ভারত-পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে পেছনে ফেলতে সহায়তা করেছে।