এম শাহজাহান ॥ দীর্ঘ ত্রিশ বছরের প্রবাস জীবন শেষে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন। কঠোর পরিশ্রম ও সততার গুণে এতদিনে তিনি বড় অঙ্কের পুঁজি জমিয়েছেন। বর্তমান তিনি একজন উদ্যোক্তা। তাই আর বিদেশ নয়, এবার দেশেই কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। এই স্বপ্ন তার উজ্জ¦ল ভবিষ্যতের। ভালবাসেন দেশকে। তাই চিন্তায় আছে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নও। এজন্য প্রয়োজন নতুন কিছু করা। দেশের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করতে চান তিনি। কিন্তু তার এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রয়োজন জমি, বিদ্যুত, গ্যাস, ট্রেড লাইসেন্স, আমদানি-রফতানি নিবন্ধন সার্টিফিকেট, পরিবেশ ছাড়পত্র, টিআইএন ও ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন, কারখানার নিবন্ধন, ব্যাংক ঋণ, ইন্স্যুরেন্স ও অগ্নিনিরাপত্তা সনদসহ আরও ১৫ ধরনের সেবা। এসব সেবা পেতে আকরাম হোসেন বছরের পর ঘুরছেন এক অফিস থেকে আরেক অফিস, এক দফতর থেকে আরেক দফতরে। প্রতিটি সেবার জন্য তাকে গুনতে হচ্ছে ঘুষ ‘স্পিড’ মানি। তারপরও সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না। জাপানের বাণিজ্য সংস্থা জেট্রো (জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশন) তাদের গবেষণায় বলছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে ১৩ ধরনের আমলাতান্ত্রিক বাধা রয়েছে। আমলাতন্ত্রের এই কঠিন ফাঁদে আটকে আছে বিনিয়োগ। এটি শুধু একজন আকরাম হোসেনের গল্প নয়, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশী-বিদেশী সব উদ্যোক্তা এখন আমলাতন্ত্রের জালে বন্দী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর এ কারণেই দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ বাড়ছে না।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা মনে করেন, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে সরকারের ঘোষিত বিনিয়োগ পলিসি বাস্তবায়ন করতে হলে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে সব ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করে বিনিয়োগ বোর্ড ঘোষিত ‘ওয়ানস্টপ’ সার্ভিস বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের পূর্ণ নিশ্চয়তা, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নির্ধারণ করা, সরকারী অফিসগুলোতে কার্যকরভাবে ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করা, ঢাকার বাইরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ প্যাকেজ সুবিধা চালু, বিশেষ বিশেষ শিল্পে কর অবকাশ সুবিধা প্রদান, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, ইউটিলিটি সার্ভিসসহ দ্রুত অর্থনৈতিক জোনগুলো তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এছাড়া অর্থনৈতিক নীতিসমূহ শিল্প, বাণিজ্য, রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় করা প্রয়োজন। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শ না নিয়ে বিনিয়োগের জন্য শিল্প সহায়ক পলিসি করতে হবে। সুদের হার ১০ বছরের জন্য ৯ শতাংশ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, উচ্চ সুদ দিয়ে কখনও কোন দেশে শিল্পায়ন হয়নি, বাংলাদেশেও হবে না। বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে রাষ্ট্রের সহযোগিতা সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। চীন যা পারছে তা বাংলাদেশের ধোলাইখালেও সম্ভব। এজন্য সহায়ক শিল্পনীতি করতে হবে। তিনি বলেন, এদেশের কত হাজার কোটিপতি রয়েছেন আর কতজন কর দেন ও কারা মানিলন্ডারিং করছেন তা খুঁজে বের করতে হবে। সর্বক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে সরকারী-বেসরকারী উভয় খাতে বিনিয়োগ বাড়বে। আবুল বারকাতের মতে, বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। সমস্যা অর্থনৈতিক কিন্তু তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।
জানা গেছে, রূপকল্প ভিশন-২১ বাস্তবায়ন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এতে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। এ লক্ষ্যে সপ্তম পঞ্চম বার্ষিকীতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ লাখ কোটি টাকা। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে ১ কোটি ২৯ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে সরকার। শুধু তাই নয়, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে ব্যাপক কর্মসূচী। এ লক্ষ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা, বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো, গ্যাসের পরিবর্তে কয়লা ও বিদ্যুতভিত্তিক কারখানা প্রতিষ্ঠা, বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন, অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারী বিনিয়োগে অগ্রাধিকার, দ্রুততম সময়ে আটটি প্রকল্প বাস্তবায়ন, সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব বাড়ানো, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, উৎপাদনে নৈপুণ্য উন্নয়ন এবং বহির্বাজার সম্প্রসারণের মতো কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের এসব কর্মসূচী দেখে চীন, জাপান, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারা এদেশে বিনিয়োগের জন্য মুখিয়ে আছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সরকারের কোন উদ্যোগ কাজে আসছে না।
জানা গেছে, শিল্পকারখানায় বিদ্যুতের সংযোগ পেতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে লাগে ১০৬ দিন, আর বাংলাদেশে ৪২৯ দিন। ভারতে ৪৭ দিনে জমির নিবন্ধন পাওয়া গেলেও এদেশে লাগে ২৪৪ দিন। এছাড়া ভারতে ফুটপাথের একজন ব্যবসায়ীকে দৈনিক ১০ টাকা চাঁদা দিতে হলেও বাংলাদেশে এ হার ১২০ টাকা। এছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে লেনদেনের ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিশ্বমানে ব্যবসায়িক পবিবেশে দুই ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৭৪-এ নেমে এসেছে। আগে ছিল ১৭৬। এসব কারণে বিদেশী উদ্যোক্তাদের মনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হয়েছে। তাই দেশে যতটা বিনিয়োগ হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। বরং দিন দিন উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বিনিয়োগ করতে গিয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের গ্যাস ও বিদ্যুত সরবরাহের নিশ্চয়তা পেতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারের দফতরে ঘুরতে হয়, যা আসলে বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) একাই করতে পারে। আবার বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন তথ্য ও সেবা পেতে এক অফিস থেকে আরেক অফিসে ঘুরলেও তারা বিনিয়োগের ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে কোন নির্দেশনা পান না। সম্প্রতি চীন, জাপান ও কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যেসব খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে কয়েক বছর চেষ্টা চালিয়েও বিনিয়োগের সুযোগ পায়নি, তারা এখন মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, চীন ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ এবং ফিলিপিন্সসহ বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। দেশেও অনেক বড় বড় বিনিয়োগকারী রয়েছেন, যারা অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছেন। কোরিয়ার বিখ্যাত কোম্পানি স্যামসাং বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েও জমির নিশ্চয়তা না পেয়ে এখন ভিয়েতনামে গিয়ে বিনিয়োগ করছে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারাও নতুন কারখানা চালু করতে না পেরে ভিয়েতনামে বিনিয়োগের স্বপ্ন দেখছেন।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে জেট্রো বলছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ১৩ ধরনের বাধাই নয়, এর পাশাপাশি ভূমি রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থার দুর্বলতা সবসময়ই জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে বিনিয়োগকারীদের। ভূমি অফিসগুলোর সেবাও খুব নিম্নমানের, শ্লথগতির ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। তারা আইনও মেনে চলে না। এ অবস্থায় বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে যারা জমি কিনতে চান, তাদের ভয়াবহ খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো বড় সমস্যা। এর পাশাপাশি রয়েছে ব্যাংক ঋণের অতিরিক্ত সুদ। এছাড়া কারখানা স্থাপনের পরও উদ্যোক্তারা বিদ্যুত ও গ্যাসের সংযোগ পাচ্ছে না। গ্যাস সংযোগ তো বন্ধই রাখা হয়েছে। এই বাস্তবতায় বেসরকারী খাতে বিনিয়োগে ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ হার কিছুটা কমেছে কিন্তু বিনিয়োগ বাড়াতে হলে এটা সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসতে হবে। এফবিসিসিআই থেকে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
এদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময়ী দেশ বলে মনে করে যুক্তরাজ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ঘুষ, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেছে দেশটি। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ‘ডুয়িং বিজনেস ইন বাংলাদেশ : শীর্ষক ট্রেড এ্যান্ড এক্সপোর্ট শীর্ষক’ সরকারী এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করেছে।
বিনিয়োগ না হয়ে টাকা পাচার হচ্ছে ॥ মন্ত্রণালয় ও সরকারী বিভিন্ন অধিদফতরের অসহযোগিতা ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের কারণে বিনিয়োগ না করে উদ্যোক্তারা টাকা পাচার করছেন। জানা গেছে, দেশে শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, আবাসন, কৃষিসহ নানা খাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের একটি বড় অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পে মাত্র পাঁচ লাখ রিঙ্গিত (প্রায় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা) বিনিয়োগ করেই যেকোন বাংলাদেশী দেশটির কাছ থেকে পাচ্ছেন ১০ বছর মেয়াদী মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা। যত দিন খুশি সেখানে থাকতে পারবেন স্বামী-স্ত্রী ও ২১ বছরের কম বয়সী সন্তানদের নিয়ে। যতটা সম্ভব বাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনা ছাড়াও শুল্ককরমুক্ত গাড়ি কেনার সুযোগও দিচ্ছে দেশটি। তথ্যানুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কর্মসূচীতে মোট ২৪ হাজার ১০৫ জন বিদেশী নাগরিক বিনিয়োগ করেছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশী রয়েছেন ২ হাজার ৭৫৫ জন। মূলত চীন ও জাপানের পরই মালয়েশিয়ার ওই কর্মসূচীতে বিনিয়োগকারীদের তালিকায় বাংলাদেশীরা এগিয়ে রয়েছেন। এ সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অবকাঠামো, দুর্নীতি ও ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদই বড় সমস্যা, যা প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বিনিয়োগের অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে হলে আগে এসব বাধা দূর করতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিনিয়োগের যে পরিবেশ বিরাজ করছে তাতে সপ্তম পঞ্চমবার্ষিকী লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৩২ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুঃসাধ্য।
ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে পারেনি বিনিয়োগ বোর্ড ॥ দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করতে পারেনি বিনিয়োগ বোর্ড। এ সার্ভিস চালু হলে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগসহ সব ধরনের সার্ভিস এখান থেকে পেতেন বিনিয়োগকারীরা। তবে বিনিয়োগের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বিদেশী বিনিয়োগের জন্য ‘ওয়ান স্টপ’ সেবার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (জয়েন্ট চেম্বার)। সম্প্রতি বিনিয়োগ বোর্ড ও জয়েন্ট চেম্বার আয়োজিত এক সেমিনারে কানাডা চেম্বারের সভাপতি মাসুদ রহমান ভারতের উদাহরণ টেনে বলেন, ওখানে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য ওয়ানস্টপ সেবা চালু রয়েছে, যে জন্য দেশটি অনেকদূর এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সুযোগ থাকলে দেশের শিল্প ও অবকাঠামো উন্নয়নে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছানো অনেক সহজ হতো। কিন্তু বাংলাদেশে বিনিয়োগ জটিলতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদ ওই অনুষ্ঠানে বলেন, ওয়ানস্টপ সার্ভিসের ক্ষেত্রে জটিলতা থাকায় তা এখনই সম্ভব হয়ে উঠছে না। তিনি বলেন, এতসব প্রতিকূলতা থাকার পরও ২০০৯ সাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বিওআই তার সেবাসমূহ আগের তুলনায় অনেক সহজ করেছে।
বিনিয়োগ কমছে ॥ গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৪৩২ প্রকল্পে ৬ কোটি ৪৭ লাখ ২ হাজার ৯০৭ মিলিয়ন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে। আর চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নিবন্ধিত বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার মিলিয়ন ডলার। অপরদিকে একই সময়ে দেশী বিনিয়োগের হারও সন্তোষজনক নয়। ব্যাংক সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোতে ঋণের চাহিদা কমায় উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুশ্চিন্তা। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুদিন ধরে ঋণ ও আমানতে সুদহার কমাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতদিন ব্যাংকগুলো ঋণের তুলনায় আমানতের সুদহার বেশি কমিয়ে আসছিল। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো সুদের হার কিছুটা কমালেও তা এখনও অনেক বেশি। এত সুদে বিনিয়োগ লাভজনক করা সম্ভব নয়। এছাড়া দেশী বিনিয়োগেও গতি নেই। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৫ অনুযায়ী, দেশে এখন বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত ২০১১-১২ অর্থবছরে বিনিয়োগের হার ছিল ২৮ দশমিক ২৬ শতাংশ। চার বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র পৌনে ১ শতাংশ।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, অবকাঠামো ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ছে না। তিনি বলেন, সরকারী বিনিয়োগ মূল্যের দিক থেকে বাড়লেও গুণগতমানের দিক থেকে কমছে। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে হবে। সহজ শর্তে ঋণ পাওয়াসহ গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে পারলে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ঝুঁকি কমাতে ট্রেডিং ব্যবসা ॥ বিনিয়োগ না করে উদ্যোক্তারা ট্রেডিং ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। এতে ঝুঁকিও কম বলে মনে করেন তারা। যাবতীয় ইলেক্ট্রনিক্স, ইলেকট্রিক সামগ্রীসহ কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র খাবার আইটেম, প্রসাধনী সব কিছুই চীন, ভারত ও থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী জনকণ্ঠকে বলেন, বিনিয়োগে ঝুঁকি বেশি তাই আমদানি করে সারাদেশে পণ্য বাজারজাত করা হচ্ছে। এতে ঝুঁকি কম লাভ বেশি হচ্ছে।
বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারী উদ্যোগ ॥ বিদেশী বিনিয়োগ আনতে ইতোমধ্যে শীর্ষ নির্বাহীদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। টাস্কফোর্সের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিদেশী বিনিয়োগ বাড়াতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়ার নির্দেশও দেয়া হয়েছে, যাতে দেশে কাক্সিক্ষত বিদেশী বিনিয়োগ আসে। গঠিত টাস্কফোসের্র প্রধান করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে। এ টাস্কফোর্সের কাজের আওতায় বলা হয়েছে, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজনীয় জমি নির্বাচন করা, পিপিপির আওতায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও বিদ্যুত উৎপাদন নিশ্চিতকরণ, প্রকল্পসমূহে অর্থায়নের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা। ইতোমধ্যে ৩০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে চট্টগ্রামের আনোয়ারার গহিরা ও মীরসরাই, মৌলভীবাজারের শেরপুরে, সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুসংলগ্ন এলাকায় এবং বাগেরহাটের মংলায় এ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে।