ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

দিনদুপুরে প্রকাশক হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১ নভেম্বর ২০১৫

দিনদুপুরে প্রকাশক হত্যা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ খোদ রাজধানীতেই দিনদুপুরে মুক্তমনা লেখক অভিজিত রায়ের বই প্রকাশক শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক, দুই লেখক ও ব্লগারসহ ৩ জনকে কুপিয়ে ও গুলি চালিয়ে হত্যাচেষ্টার ৪ ঘণ্টার মাথায় আরেক প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে ছুরিকাঘাতে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। দীপনকে শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের জাগৃতি প্রকাশনীর তৃতীয় তলার নিজ অফিসেই হত্যা করা হয়। নিজেদের আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের শাখা (একিউআইএস) দাবি করে হামলার দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলামের নামে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। হত্যার দায় স্বীকার ॥ নিহত দীপনের মাথা কম্পিউটারের কিবোর্ডের ওপর পড়ে ছিল। আহতদের মধ্যে শুদ্ধস্বর প্রকাশক নিজের নিরাপত্তা চেয়ে মোহাম্মদপুর থানায় জিডি করেছিলেন। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। হামলায় আহত হতে হলো। আহত তিনজনের মধ্যে লেখক তারেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। দুটি ঘটনার পর দেশ-বিদেশে হৈচৈ পড়ে গেছে। দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। এ ঘটনায় প্রগতিশীল লেখক ও প্রকাশকরা রীতিমতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁরা সরকারের কাছে নিরাপত্তাসহ হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে দুটি তাজা বুলেট ও একটি বুলেটের খোসা এবং আশপাশের ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পর্যালোচনা চলছে। ঘটনার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের কড়া নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। উন্নত চিকিৎসার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করবে বলেও তিনি জানান। ঘটনার পর ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা হতাহতদের খোঁজখবর নেন। আহতদের দেখতে মেডিক্যালে যান। ঢাকা মেডিক্যালের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। ঢাকায় জারি করা হয়েছে রেড এ্যালার্ট। শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে যেভাবে হামলা করা হয় ॥ শনিবার দুপুর আড়াইটার দিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়া সি ব্লকের ৮/১৩ নম্বর ৫ তলা বাড়ির চতুর্থ তলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কার্যালয়ে প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল (৫০), লেখক এবং ব্লগার প্রকৌশলী তারেক রহিম (৪২) ও রণদীপম বসুকে (৪০) ছুরিকাঘাতে ও গুলি চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়িটিতে ঢোকার দুটি গেট। দুটি গেটই সব সময় খোলা থাকে বলে স্থানীয়রা জানান। ঘটনার সময় প্রথমে ২ যুবক শুদ্ধস্বর প্রকাশনীতে যায়। তারা দরজায় নক করে। দরজা খুলে দিলে তারা বই কিনতে এসেছে বলে জানায়। ঢুকতেই প্রথম রুমে তিন সিটের একটি লাল ও একটি সাদা সোফা পাশাপাশি রাখা। সেখানেই বসে ছিলেন প্রকাশকসহ দুই লেখক। দুই যুবক প্রবেশের পর পরই তিন যুবক সেখানে প্রবেশ করে। সে সময় ওই ফ্ল্যাটে ৫ জন ছিল। এদের একজন রাসেল শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্মচারী। অপরজন ওয়াশিকুর রহমান শক্তি বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকম অনলাইন পত্রিকার কর্মচারী। তাদের কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে অন্য কক্ষে নিয়ে আটকে রাখা হয়। দুইজনকে আটকে রাখার পর ব্যাগ থেকে চাপাতি বের করে তিনজনকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে হামলাকারীরা। পরে গুলি চালায়। উদ্ধার তৎপরতা ॥ তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন আসার আগেই হত্যাচেষ্টাকারীরা ঘরের দরজার বাইরে তালা লাগিয়ে চলে পালিয়ে যায়। রাসেল আহত টুটুলের মাধ্যমে ঘটনাটি টুটুলের বন্ধু দৈনিক সমকালের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তাফিজ শফিকে জানিয়ে তাদের উদ্ধারের অনুরোধ জানান। মোস্তাফিজ শফি বিষয়টি পুলিশকে জানান। একই সময়ে ওয়াশিকুর রহমান শক্তি এসএমএস করে ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি বিপ্লব কুমার সরকারকে এসএমএস করে তাদের উদ্ধারের অনুরোধ জানান। পরে তালা ভেঙ্গে তিনজনকে উদ্ধার করা হয়। দ্রুত তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। জব্দ আলামত ॥ সিআইডির ক্রাইম সিন ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ঘটনাস্থল থেকে একটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ বোরের পিস্তলের তাজা বুলেট ও একটি বুলেটের খোসাসহ ঘটনাস্থল থেকে প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। ঘটনার পর পরই আহতদের চিৎকারে আশপাশের মানুষ সেখানে পৌঁছার আগেই হত্যাকারীরা মোটরসাইকেলযোগে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ॥ বাড়িটির চতুর্থ তলারই উত্তর দিকের ভাড়াটিয়া ধানম-ির ম্যাপল লিফ ইন্টারন্যাশনাল ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক সৈয়দ গোলাম মোর্শেদ বলেন, গেট দুটি প্রায় সময়ই খোলা থাকে। ঘটনার সময় তিনি বাথরুম থেকে চিৎকারের শব্দ শুনছিলেন। স্থানীয়রা সেখানে পৌঁছার আগেই হত্যাকারীরা পালিয়ে যায়। চিকিৎসকের বক্তব্য ॥ বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ঢাকা মেডিক্যালের জরুরী বিভাগের আবাসিক সার্জন ডাঃ কেএম নিয়াজ মোর্শেদ সাংবাদিকদের জানান, প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের শরীরে গুলি করা হয়েছে। তাকে হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। বাকি দু’জনের অবস্থাও গুরুতর। টুটুল ও রণদীপম বসুকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে জরুরী বিভাগের অস্ত্রোপচার কক্ষে। টুটুল ও তারেক রহিমের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের মাথায় ও শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পুলিশের বক্তব্য ॥ ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান আহতদের দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, তারেক রহিমের মাথায় গুরুতর আঘাত এবং কোমরে গুলি লেগেছে। হত্যাচেষ্টাকারীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, মোহাম্মদপুরের ঘটনাস্থল থেকে ২টি তাজা বুলেট ও একটি বুলেটের খোসা উদ্ধার হয়েছে। পৃথক দুটি ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। হত্যাকারীদের শনাক্ত করে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। যদিও রাত একটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পৃথক দুটি ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে কাউকে আটক করা হয়নি। তবে ঘটনা সম্পর্কে জানতে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের জবানবন্দী নেয়া হয়েছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্র ও হামলার ধরন একই বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাত ১০টার দিকে হত্যার দায় স্বীকার করে আনসার আল ইসলামের নামে বিবৃতি দেয়া হয়েছে। কোথা থেকে কারা কি উদ্দেশ্যে বিবৃতি পাঠিয়েছে সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যি সত্যিই আনসার আল ইসলাম দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে, নাকি সংগঠনটির নামে অন্য কেউ বিবৃতি দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আহতদের পরিচয় ॥ শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের বাড়ি সিলেটে। তার দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। আর আহত রণদীপম বুসুর বাড়ি সুনামগঞ্জে। তিনি এ নামে ফেসবুকে লেখালেখি করেন। তবে তার প্রকৃত নাম সুদ্বীপ কুমার বর্মন। শুদ্ধস্বর প্রকাশনীটি চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসটিতে খুন হওয়া মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা, লেখক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রকৌশলী অভিজিত রায়ের একাধিক বই প্রকাশ করেছে। অভিজিত রায়কে হত্যার পর থেকেই প্রকাশক টুটুলকে হত্যার চেষ্টা হচ্ছিল। শুদ্ধস্বর প্রকাশনীটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। প্রগতিশীল লেখকদের লেখা প্রকাশ করে আলোচনায় ছিল প্রকাশনী সংস্থাটি। আহত প্রকাশক বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রশাসক সমিতির সদস্য। অভিজিত রায়কে হত্যার পর থেকে টুটুলকে হুমকি দেয়ার ঘটনায় রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় নিরাপত্তা চেয়ে একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন তিনি। প্রকাশক দীপন হত্যা ॥ শুদ্ধস্বরে হামলার প্রায় ৪ ঘণ্টা পর রাজধানীর রাজধানীর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ১৩২ নম্বর জাগৃতি প্রকাশনীর মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে (৪০) নিজ অফিসে ছুরিকাঘাতে, গলা কেটে ও ঘাড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। দীপন নিহত অভিজিত রায়ের বইয়েরও প্রকাশক ছিলেন। জাগৃতি প্রকাশনীর ম্যানেজার আলাউদ্দিন জানান, তিনি সাড়ে ৩টার দিকে প্রথমে অফিসে যান। এ সময় দীপন অফিসে ছিলেন। তাকে সঙ্গে নিয়েই তিনি নিচতলায় যান। সেখানে কাজের তদারকি করার পর ছাপানো ভিজিটিং কার্ডসহ বিকেল তিনি নিজ অফিসে চলে যান। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি অফিসে যান। গিয়ে দেখেন, অফিসের নিচ থেকে রক্ত বেয়ে আসছে। এমন ঘটনা দেখার পর তিনি আজিজ সুপার মার্কেট কর্তৃপক্ষকে জানান। তারা সবাই অফিসে যান। বাইর থেকে তালাবদ্ধ ছিল। সবাই মিলে তালা ভাঙ্গা হয়। ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, দীপনকে ছুরিকাঘাতে, ঘাড়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। দীপনের মাথাটি কম্পিউটারের কিবোর্ডের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। দ্রুত দীপনকে উদ্ধার করে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন সন্ধ্যা পৌনে ৭টা। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত ৮টার দিকে চিকিৎসক দীপনকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডাঃ কেএম নিয়াজ মোর্শেদ জানান, দীপনের ঘাড়ে এত জোরে কোপ দেয়া হয়েছে যে, গলা কেটে কণ্ঠনালী পর্যন্ত কেটে গেছে। এতে করে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতালে আনার আগেই দীপনের মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দীপন ৭টার দিকে মারা যান। নিহত দীপনের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক। নিহতের একটি কন্যা ও একটি পুত্র সন্তান রয়েছে। নিহতের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। দীপনের পিতার অভিযোগ ॥ দীপনের পিতার অভিযোগ, নিহত অভিজিত রায়ের বই প্রকাশ করায় তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। দীপনের একাধিক শুভাকাক্সক্ষী জানান, বইমেলা থেকে জাগৃতি প্রকাশনীর তরফ থেকে লেখক অভিজিত রায়ের প্রকাশিত বই তুলে ফেলতে দীপনকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। হুমকিদাতারা বই না তুললে কঠিন পরিণতি হবে বলেও হুমকি দিয়েছিল। যেভাবে হতাহতদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ॥ বই প্রকাশের সূত্রে টুটুল এবং বিজ্ঞান লেখক অভিজিত রায়ের মধ্যে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। গত ১২ সেপ্টেম্বর ছিল অভিজিত রায়ের জন্মদিন। প্রয়াত বন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন টুটুল। তাতে সমাজ, রাজনীতিও তাঁর বক্তব্যও ফুটে ওঠে। টুটুল লিখেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর দীর্ঘ মেয়াদি সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ হয়ে ওঠে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির চারণক্ষেত্র। এই সময়েই সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজিবাদের আগ্রাসনে পেরেস্ত্রোইকা, গাসনস্তকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার দায় নিয়ে পিছু হঠতে হয় আদর্শ সমাজতন্ত্রকে। তখনই আফগানিস্তানে সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্ট তালেবানরা অস্ত্র আর উম্মাদনা দিয়ে মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ধর্মীয় রাজনীতির বিকাশে উৎসাহ যোগায়। এই অবস্থায় বাংলাদেশে আদর্শবাদী ছাত্র সংগঠনগুলোর কাঠামো ভেঙ্গে যেতে থাকে, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র পাড়ার ক্লাব/ পাঠাগারগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। এভাবেই ঝিমিয়ে পড়ে যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার চর্চা আর খুব দ্রুত এ দেশের আবহমানকালের সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে পড়ে তালেবানি ঘেরাটোপ।’ অবস্থার উন্নতির জন্য তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি ওই একই স্ট্যাটাসে অভিজিত রায়ের ভূমিকা উল্লেখ করে লেখেন, ‘এই শতাব্দীর প্রথম দশকে ইন্টারনেট প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে পৃথিবী চলে আসে মানুষের হাতে মুঠোয়। বাংলাদেশেও এর ছোঁয়া লাগে। বাংলাদেশের সচতেন মানুষেরা দ্রুতই অভ্যস্ত হয়ে উঠেন মেল, ব্লগ আর অনলাইন ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই মাধ্যমেই স্তিমিত হয়ে পড়া যুক্তি আর বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা, তর্ক, সমালোচনা-পর্যালোচনা পুনরায় তরুণদের অধিক মাত্রায় টানতে শুরু করে। এসব লেখালেখি বই আকারেও প্রকাশিত হতে শুরু করে। এই আলো ছড়ানো, ভাবতে শেখানো কলম যোদ্ধাদের অন্যতম অগ্রপথিক হলেন শহীদ অভিজিত রায়।’ অভিজিত রায় তাঁর ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির ভূমিকায় প্রকাশক টুটুলের সাহসীকতার প্রশংসা করেন লিখেছেন, “শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল নিষেধ করেছেন ‘তাঁর অবদান ছাড়া কখনও এ বই আলোর মুখ দেখতো না’ টাইপ মুখস্থ কথা লিখতে। কিন্তু লিখতেই হলো। কারণ বাংলাদেশে এ ধরনের বই লেখাটাই শেষ কথা নয়, বইটি পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন সমমনা এবং সাহসী একজন প্রকাশক। এ কৃতিত্বটুকু উদ্যমী ও সাহসী এ প্রকাশকের প্রাপ্য।” টুটুলের মতো লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যদিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন ফয়সাল আরেফিন দীপন। ১৯৮৪ সাল। তখন দীপন ‘লোকায়িত’ শিরোনামে একটি লিটল ম্যাগ প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেড়ে ওঠা দীপন ছোটবেলা থেকে মুক্তচিন্তা, যুক্তিবাদ ও অসাম্প্রাদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করতেন। লেখালেখি কম করলেও ছিলেন ভাল পাঠক। এক সময় ‘লোকায়িত’ লিটল ম্যাগটিই তিনি রূপান্তর করেন জাগৃতি প্রকাশনী হিসেবে। সেটা ১৯৯২ সালের কথা। মাত্র পাঁচটি বই নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে প্রকাশনী সংস্থাটি। লিটল ম্যাগের কাজ করতে করতে একটা সময় বইয়ের প্রতি ভালবাসা ও মমত্ববোধ তৈরি হয়। আর সে থেকেই মূলত প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। সৃজনশীল ও মননশীল বই প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে অর্জন করে পাঠকের ভালবাসা। প্রকাশনী সংস্থাটি এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার বই প্রকাশ করেছে। নিহত দীপন লেখক ও গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হকের একমাত্র ছেলে ছিলেন। একমাত্র বোন তার ছোট। দীপন লেখক অভিজিত রায়ের সহপাঠী ছিলেন। অভিজিত রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। দীপন ও অভিজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সুলিমুল্লাহ মুসলিম হল সংলগ্ন উদয়ন স্কুলে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলেন। পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন দীপন। পরে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়াশোনা করেছেন তিনি। দীপনের স্ত্রী পেশায় চিকিৎসক। তাঁদের দুই সন্তান। প্রকাশক মহলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক। ফেসবুকে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীলতার স্বপক্ষে তিনিও ছিলেন সরব ও সোচ্চার। ক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল হতাহতদের দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেলে ক্ষোভের মুখে পড়েন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তিনি হতাহতদের দেখতে এসেছেন। তিনি আরও বলেন, যারা দেশকে অকার্যকর করতে চায়, সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব খুনীদের প্রতিহত করতে সবাইকে একত্রিত হতে হবে। এ সময় তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন। এর আগে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাবেক স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এসএম কামাল হোসেনসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাহতদের দেখতে হাসপাতালে যান। তাঁরা হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলত শাস্তির আওতায় আনতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে সাংবাদিকদের জানান। নিন্দা ॥ বাংলাদেশস্থ যুক্তরাজ্য দূতাবাসসহ বিএনপি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের তরফ থেকে এমন ঘটনায় চরম নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। নিন্দা বার্তায় হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে। আলোচিত ঘটনাসমূহ ॥ ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করেন। কাদের মোল্লাসহ সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়। সেই মঞ্চে যোগ দেন মুক্তমনা, প্রগতিশীল লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পক্ষের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে এত মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল। ২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যাচেষ্টা হয়। একই বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রকৌশলী ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে ঢাকার পল্লবী থানাধীন পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই ছুরিকাঘাতে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। ওই বছরের ৯ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা ও ব্লগার আরিফ রায়হান দ্বীপকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হল থেকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে বুয়েটেরই আরেক ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন। ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন রামকৃষ্ণ (আর কে) মিশন রোডের বাড়িতে জবাই করে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি ও বিশ্বত্রাণ কর্তা দাবিদার লুৎফোর রহমান ফারুক (৫৫) ও তার ছেলে সানোয়ারুল ইসলাম মনিরসহ (৩০) ৬ জনকে ছুরিকাঘাতে ও গলা কেঁটে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন পূর্ব রাজাবাজারের নিজ বাড়িতে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের শান্তির পথে ও কাফেলা নামক ইসলামী অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুুরুল ইসলাম ফারুকীকে জবাই করে হত্যা হয়। চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় রাত ৯টায় দুই যুবক চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে লেখক অভিজিত রায়কে হত্যা করে। বাধা দিতে গিয়ে আহত হন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ বছরের ৩০ মার্চ রাজধানীর রমনা মডেল থানাধীন হাতিরঝিল বেগুনবাড়িতে দিনের বেলায় ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এখন পর্যন্ত রাজীব, দ্বীপ ও বাবু হত্যায় গ্রেফতারকৃতদের আদালতে দেয়া আলাদা আলাদা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেছেন, ইমানি দায়িত্ব পালন করতেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। চলতি বছরের ১২ মে সিলেটের সুবিদবাজারে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে একই এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। চলতি বছরের ৭ আগস্ট দুপুর দেড়টার দিকে রাজাধানীর খিলগাঁও থানাধীন পূর্ব গোড়ানের ৮ নম্বর সড়কের ১৬৭ নম্বরের পাঁচতলা বাড়ির পঞ্চমতলার পূর্বদিকের নিজ বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার নীলাদ্রি চ্যাটার্জী নিলয়কে। চলতি বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর গুলশান কূটনৈতিকপাড়ায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলাকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। যদিও হত্যাকারীরা গ্রেফতার হয়েছে। এমন ঘটনার পর পরই গত ৩ অক্টোবর রংপুরে জাপানী নাগরিক হোশি কুনিওকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ৫ অক্টোবর দিবাগত রাত পৌনে ৮টায় রাজধানীর বাড্ডা থানাধীন মধ্যবাড্ডার গুদারাঘাট এলাকার জ- ব্লকের ১০/১ নম্বর ৬ তলা নিজ বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বাড়ির সবাইকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা খিজির খানকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এর আগে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে টিএসসিতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে লেখক হুমায়ুন আজাদকে আহত করা হয়। পরবর্তীতে বিদেশে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ব্লগার রাজীব, দ্বীপ, বাবু, ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেলা, জাপানী নাগরিক হোশি কুনিও এবং পিডিবির চেয়ারম্যান খিজির খান হত্যাকা-ের রহস্য প্রায় পুরোপুরিই উদঘাটিত হয়েছে। অন্যগুলোর রহস্যের জট খুলতে তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে তদন্তকারী সংস্থাগুলো দাবি করেছে।
×