ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

waltonbd
waltonbd
আগুন থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে বছরে ১৫ লাখ লোকের মৃত্য

আগুন থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে বছরে ১৫ লাখ লোকের মৃত্য

আগুন থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণে বিশ্বব্যাপী বছরে ১৫ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। এ মৃত্যুর বেশিরভাগই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ঘটে। বৃহস্পতিবার নতুন এক গবেষণায় এ কথা বলা হয়েছে। দ্য ল্যানসেট জার্নালের সমীক্ষা অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দাবানল আরও ঘন ঘন ও তীব্র হওয়ার কারণে এ মৃত্যুর সংখ্যা আগামী বছরগুলোতে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। খবর আলজাজিরা ও বিবিসি অনলাইনের। গবেষকদের আন্তর্জাতিক দল ‘ল্যান্ডস্কেপ ফায়ার’-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রাকৃতিকভাবে ছড়িয়ে পড়া দাবানল ও চাষের জমিতে নিয়ন্ত্রিতভাবে মানব সৃষ্ট আগুন, উভয়ই এ দূষণের জন্য দায়ী। গবেষকরা জানান, ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে হৃদরোগের কারণে বছরে প্রায় ৪৫০,০০০টি মৃত্যু ঘটে। এই মৃত্যুগুলোর সঙ্গে আগুন-সম্পর্কিত বায়ুদূষণ দায়ী। শ্বাসযন্ত্রের রোগে আরও ২২০,০০০ মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়েছে আগুনের মাধ্যমে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া ও কণাকে। সমীক্ষা অনুসারে, বিশ্বজুড়ে বছরে মোট ১.৫৩ মিলিয়ন মৃত্যুর জন্য আগুনের কারণে সৃষ্ট বায়ুদূষণ দায়ী। এতে আরো বলা হয়, এ মৃত্যুর ৯০ শতাংশেরও বেশি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে হয়েছে। কেবল সাব-সাহারান আফ্রিকায় প্রায় ৪০ শতাংশ মৃত্যু ঘটেছে। চীন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও নাইজেরিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর সংখ্যা রয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে উত্তর ভারতে বেআইনিভাবে খামারের জমিতে রেকর্ড পরিমাণ পুড়িয়ে ফেলার কারণে সৃষ্ট ক্ষতিকারক ধোঁয়াশাকে বায়ুদূষণের জন্য আংশিকভাবে দায়ী করা হয়েছে। যার ফলে সম্প্রতি রাজধানী নয়াদিল্লির বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক দূষণ দেখা দেয়। ল্যানসেট স্টাডির লেখকরা ল্যান্ডস্কেপ দাবানলে বিপুল মৃত্যুর সংখ্যা মোকাবিলায় ‘জরুরি পদক্ষেপ’ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিবেদনটিতে ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে অধিকতর ‘জলবায়ু বৈষম্য’কে তুলে ধরা হয়। এখানে দেখানো হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে যারা সবচেয়ে কম অবদান রেখেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি ভুগছে। কিছু উপায় মানুষ আগুন থেকে ধোঁয়া এড়াতে পারে। যেমন- এলাকা থেকে দূরে সরে যাওয়া, এয়ার পিউরিফায়ার ও মাস্ক ব্যবহার করা, বা বাড়ির ভেতরে থাকা। তবে এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা গরিব দেশগুলোর মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় বলে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন। তাই তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মানুষের জন্য আরও আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে। সমীক্ষাটি জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনার এক সপ্তাহ পরে প্রকাশিত হয়, যেখানে প্রতিনিধিরা জলবায়ু তহবিল বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ তহবিলকে অপর্যাপ্ত বলে সমালোচনা করে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শান্তিপ্রিয় মানুষ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় শান্তিপ্রিয় মানুষ

রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের পর, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের আশঙ্কায় কাঁপছে পুরোবিশ^। কারণ, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ মানেই পরমাণু যুদ্ধের আশঙ্কা। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা চালানোর অনুমতি দিয়েছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তের ফলে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত নিয়ে ওয়াশিংটনের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিগত কয়েক মাস থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রুশ ভূখণ্ডের গভীরে এমন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আসছিলেন। অবশেষে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষের দুই মাস আগে বাইডেন এমন অস্ত্র ব্যবহারের সবুজ সংকেত দিলেন। এর পূর্বে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সতর্ক করেছিলেন যে, এমন পদক্ষেপ মানে ন্যাটো মিত্র জোট সরাসরি ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে পুতিন বলেছিলেন, যদি পশ্চিমারা ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাতে দেয়, এটির অর্থ হবে তারা সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পুতিন হুমকি দিয়ে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ চলমান যুদ্ধের প্রকৃতি এবং পরিধি বদলে দেবে। নতুন এ হুমকির বিরুদ্ধে রাশিয়া যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলেও তিনি জানান। পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ কোনো দেশের মিসাইল দিয়ে ইউক্রেন যদি রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে রাশিয়া তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে। জো বাইডেনের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় মস্কো বলেছিল, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউক্রেন যদি সত্যিই মার্কিন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালায়, তাহলে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। মার্কিন প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তের কড়া প্রতিক্রয়া জানিয়ে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদায়বেলায় বাইডেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছেন। এতে করে তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এমনকি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বড় ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও বলেছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসন তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ বাধাতে চান। আমার বাবা শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জীবন বাঁচানোর সুযোগ পাওয়ার আগেই তারা তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু করতে চায়। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে জাতীয় গোয়েন্দার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রিচার্ড গ্রেনেল লেখেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের সময়ে বাইডেন যে ইউক্রেন যুদ্ধের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন, তা কেউ ধারণা করেননি। বিষয়টি এমন, তিনি নতুন একটি যুদ্ধ শুরু করেছেন। ফলে, সব বদলে গেল। আগের সকল হিসাব-নিকাশ এখন অকার্যকর। সিনেটর মাইক লি বলেন, তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করে দিলেন জো বাইডেন। কিয়েভভিত্তিক ইউক্রেনীয় নিরাপত্তা ও সহযোগিতা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান সেরহি কুজান বাইডেনের এমন সিদ্ধান্তকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন। রাশিয়ার রাজনীতিবিদরা একে গুরুতর উত্তেজনা বৃদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার আইনপ্রণেতা আন্দ্রেই ক্লিসাস তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হবে বলে সতর্কতা দিয়েছেন। ম্যাসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামে তিনি লিখেছেন, পশ্চিমারা উত্তেজনা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেখানে সকালের মধ্যে ইউক্রেন পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যেতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, ইউক্রেন যেই যুক্তরাষ্ট্রের দূরপাল্লার মিসাইল দিয়ে রাশিয়ায় হামলা চালাবে, তার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা হামলা চালানো হবে। এক্ষেত্রে কোনো দেরি করা হবে না। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হওয়ার ক্ষেত্রে এটি বড় ধাপ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ বাহিনীকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন। যুদ্ধের এক হাজারতম দিনে তিনি এ সংক্রান্ত একটি ডিক্রিতে স্বাক্ষর করেছেন বলে পুতিনের মুখপাত্র এবং ক্রেমলিনের প্রেস সেক্রেটারি দিমিত্রি পেসকভ জানান। নতুন এই ডিক্রিতে বলা হয়, যেসব দেশের পরমাণু অস্ত্র নেই, তাদের যদি তৃতীয় কোনো দেশ বা পক্ষ এ ধরনের বিধ্বংসী অস্ত্র প্রদান করে, সেক্ষেত্রে সেসব দেশের বিরুদ্ধে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। পেসকভ বলেন, পরমাণু অস্ত্র নেইÑ এমন কোনো আগ্রাসী দেশের সঙ্গে পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ কোনো দেশ যদি জোটবদ্ধ হয়, তাহলে তা আর একক নয়; বরং যৌথ হামলায় পরিণত হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের নীতি অক্ষুণ্ন রেখে যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, আমরা সেটিই নিয়েছি। তিনি আরও বলেন, রাশিয়া সবসময় পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করার বিপক্ষে। আমরা শুধু আমাদের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। জো বাইডেনের এ সিদ্ধান্ত ব্রিটেন ও ইউরোপীয় ন্যাটো অংশীদারদের ওপর রাশিয়ার প্রতিশোধমূলক নাশকতা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ, পুতিন আগেই সতর্ক করেছিলেন, ইউক্রেন যদি মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসিদের ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়িয়ে দেয়, তাহলে তা মস্কোর বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে। এর ফল হবে বিপর্যয়কর। যুদ্ধ এখন সেদিকেই মোড় নিল। জি-৭ নেতাদের একটি যৌথ বিবৃতিতে ‘যতদিন সময় লাগে ইউক্রেনের প্রতি অটুট সমর্থন’-এর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধের এক হাজার দিন পূর্তিতে। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ব্রাজিলে এ সপ্তাহে একই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেন ১৯ নভেম্বর প্রথমবারের মতো রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে। মধ্যপ্রাচ্য এমন এক অঞ্চল যেখানে কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলমান। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইরানসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর যোগদান এই অঞ্চলের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে। একই সঙ্গে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল সে¥াট্রিচ গণমাধ্যমে আয়োজিত এক টকশোতে দখলদার রাষ্ট্রটির সীমানা ইউফ্রেটিস থেকে দামেস্ক পর্যন্ত বৃদ্ধি করার পরিকল্পনার পক্ষে জোরালোভাবে যুক্তি তুলে ধরেন। এর ফলে, মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরোবিশে^ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে। সে¥াট্রিচ বলেন, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ঘিরে রেখেছে, সেই সঙ্গে মিসর এবং সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অঞ্চল এবং ইরাকে পৌঁছানো অঞ্চলগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত করার উচ্চাকাক্সক্ষা। এই তালিকায় সৌদি আরবও রয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন যে, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, মিসর এবং এমনকি সৌদি আরবের অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যেই ইরান অত্যাধুনিক সকল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে। ইরানের প্যারামিলিটারি রেভুল্যুশনারি গার্ড জানায়, এ সকল সমরাস্ত্রের মধ্যে এমন  ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন রয়েছে যা সরাসরি ইসরাইলি ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম। তেহরান মনে করে, ইসরাইলের বিরুদ্ধে অপারেশন ট্রু প্রমিজ-থ্রি পরিচালনা করা হবে, যা ওয়ান ও টু এর চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী হবে। নেতানিয়াহু প্রশাসন যা অনুমানও করতে পারবে না। গাজা ও লেবানন যুদ্ধের মধ্যে গত এপ্রিল মাস থেকে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে হামলা-পাল্টাহামলা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১ অক্টোবর ইরান ইসরাইলে ১৮১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালায়। এর জবাবে গত ২৬ অক্টোবর ইসরাইল শতাধিক যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে হামলা চালায় ইরানে। এই হামলায় রাজধানী তেহরানসহ দেশটির কয়েকটি প্রদেশের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এরপর থেকেই ইসরাইলে পাল্টাহামলা চালানো হবে বলে ইরান হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরাইলের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এমন প্রদর্শনী নেতানিয়াহু প্রশাসনের জন্য অনেকটা চাপের। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুসারে, মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ও শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে ইরানের নিকট। এ বিষয়ে ইরান জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার জন্য ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেপণাস্ত্র। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা বিষয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, গাজায় এক বছর ধরে যে গণহত্যা চলছে, তার মূল্য শেষ পর্যন্ত ইসরাইলকেই দিতে হবে। গাজা সংকট মোকাবিলায় তার দেশ প্রয়োজনে ইসরাইলে ঢুকবে। তিনি বলেন, তুরস্ক এর আগে লিবিয়ায়ও ঢুকেছে। ইসরাইলের ক্ষেত্রেও তারা ভেতরে ঢুকতে পারবে মন্তব্য করে এরদোয়ান বলেন, এ জন্য আমাদের অনেক কঠিন হতে হবে, যাতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে এ ধরনের উপহাস করতে না পারে। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিন এবং লেবাননে যারা মারা যাচ্ছে তারা শুধু নারী, শিশু এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকই নয়, মানবতা ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাও। ন্যাটো জোটের মিত্রদের থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে এরদোয়ান নেতানিয়াহুকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করেন। ইসরাইলের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, মানবতার অভিন্ন জোট যেভাবে হিটলারকে থামিয়েছে, একইভাবে নেতানিয়াহু ও তার হত্যার নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হবে। অধিকৃত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের পশ্চিমতীরে অবৈধ ইহুদি বসতির সম্প্রসারণ ইসরাইল অব্যাহত রেখেছে। ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকি মোকাবিলায় ইসলামিক দেশগুলোর একটি জোট গঠন করা উচিত বলে এরদোয়ান মনে করেন। তিনি বলেন, ঐক্যই একমাত্র পদক্ষেপ, যা ইসরাইলি দাম্ভিকতা, ইসরাইলি দস্যুতা ও ইসলামিক দেশগুলোয় ইসরাইলি রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ বন্ধ করতে পারে। ইসরাইলের এই ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণবাদ লেবানন ও সিরিয়ার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে বলে তিনি অভিহিত করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিসর ও সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তুরস্ক সম্প্রতি অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানান। সম্প্রসারণবাদের বাড়তে থাকা হুমকির বিরুদ্ধে ঐক্যের বন্ধন গড়ে তোলাই এসব পদক্ষেপের লক্ষ্য। এরদোয়ানের এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেন, এরদোয়ানের এই বক্তব্য বিপজ্জনক, মিথ্যা ও উসকানিমূলক। এরদোয়ান ইরানের সঙ্গে মিলে এই অঞ্চলের আপেক্ষাকৃত কম কট্টর দেশগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে কাজ করছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এক বছরের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় গাজার বড় অংশই বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) প্রদত্ত তথ্যানুসারে, যুদ্ধে গাজার ধ্বংস হওয়া বাড়িগুলোর ধ্বংসাবশেষ সরাতেই ১৫ বছর তথা ২০৪০ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। যুদ্ধনীতির অংশ হিসেবেই ইসরাইল এমন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে থাকে, যা ‘দাহিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিত। ইসরাইলের এই কুখ্যাত যুদ্ধনীতি লেবাননেও প্রয়োগ করা হয়েছিল। ইতোমধ্যে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল এবং দেশটির রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে ইসরাইল। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা এবং লেবাননে ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। ইসরাইলের প্রতি ইউরোপীয় জোটের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করে বলেন, ইইউ এখন পর্যন্ত ইসরাইল সরকারকে যেকোনো অর্থবহ পরিণতি থেকে রক্ষা করে চলেছে। গাজা এবং লেবাননে ইসরাইলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে বোরেল ইসরাইল থেকে আমদানি নিষিদ্ধ থেকে শুরু করে দখলদার সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ স্থগিত করার প্রস্তাব তুলে ধরেন। পাশাপাশি এই জোটের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করারও আহ্বান জানান। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে উত্তেজনাও চরমে। এতে আমেরিকা জড়িত থাকায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া ক্রমাগত নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছে। চীনও তাদের সমর্থন দিচ্ছে। চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে উত্তেজনাও ক্রমশ সংঘাতের রূপ নিচ্ছে। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজিত করছে। আবার দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিতে চীন ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধ চলমান। এই বিরোধে আবার ইন্ধন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিশ^ আজ বিভক্ত। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ইসরাইলের পক্ষে কথা বললেও তুরস্ক, রাশিয়া এবং চীন, গাজা ও তেহরানের প্রতিই সমর্থন বাড়িয়েছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, চীন সবসময়ই ইরানের বিশ^স্ত অংশীদার এবং বরাবরের মতোই ইরানকে সমর্থন করবে। ইরানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির চাপ আরোপের বিরোধিতা করবে চীন। এদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছেন, তার দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইউরোপের দেশগুলো প্রস্তুত করছে যুক্তরাষ্ট্র। চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন যদি ব্যর্থ হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপকে যুদ্ধে জড়িয়ে দেবে। মস্কোর বিরুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোর যুদ্ধ করা তাদের জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। ক্রেমলিন জানিয়েছিল, রাশিয়া ‘পরমাণু নীতি’ পাল্টে ফেলবে। এমনকি যে দেশগুলোর  নিকট আণবিক অস্ত্র নেই, তাদেরকেও আক্রমণ করা হবে, যা যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশে^র নিকট চূড়ান্ত সতর্কতা হবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েই আমরা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করব। এখনই আমরা এটা করতে চাই না। কিন্তু আমরা সবদিক থেকে প্রস্তুত থাকতে চাই। এখন পুতিনের বক্তব্যই সঠিক হতে চলেছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পরমাণু অস্ত্রের সামরিক মহড়া দিয়ে ইউক্রেন ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে সরাসরি হুমকি দিল রাশিয়া। এর ফলে, ইউক্রেন থেকেই তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নেতানিয়াহুর কার্যালয় অবরোধ

নেতানিয়াহুর কার্যালয় অবরোধ

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চটেছেন দেশটির জনগণ। তারা ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয় অবরোধ করেন। বৃহস্পতিবার টাইমস অব ইসরাইলের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আটক রয়েছেন ইসরাইলি জিম্মিরা। তাদের স্বজনেরা নেতানিয়াহুর নেসেট অফিসের প্রবেশপথ অবরোধ করেছে। জিম্মিদের ফেরাতে গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তির দাবিতে তারা এ অবরোধ করেন। লেবাননের প্রতিরোধ যোদ্ধা হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর এ বিক্ষোভ পালিত হয়। ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামীদের সংগঠন হামাসের হামলায় বন্দি হওয়া জিম্মিদের একজন এলি আলবাগ বলেন, নেতানিয়াহু লেবাননে যেভাবে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছেন ঠিক সেভাবে গাজাতেও চুক্তি করতে হবে। তিনি বলেন, আপনি যদি চান তাহলে আপনি এটি করতে পারেন। আমরা আপনার অনুগ্রহ আশা করছি। নেসেট নিরাপত্তাকর্মীরা পরে তাদের সরিয়ে দেন। এরপর তারা নিচে নেমে সিঁড়ি অবরোধ করেন। জায়গাটিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সভা ও সংবাদ সম্মেলন করে থাকে। জিম্মিদের স্বজনদের একজন শারাবি বলেন, আমরা এমন সময় যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছি যখন উত্তরের বাসিন্দা এবং ইসরাইলি নাগরিকদের জন্য এখনো স্পষ্ট বিপদ রয়েছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এখনো হিজবুল্লাহর সক্ষমতা নিঃশেষ করতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, এখন আমাদের গাজা থেকে ফিরে আসা এবং প্রয়োজনমতো গাজায় আবারও ফিরে যাওয়া সম্ভব। তবে সবার আগে আমাদের জিম্মিদের দেশে ফেরাতে হবে। গাজায় এক বছর ধরে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইল। দেশটির অব্যাহত এ হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে অন্তত ১৫ বছর সময় লাগবে। এ জন্য প্রতিদিন ১০০টি লরি ব্যবহার করতে হবে। জাতিসংঘের হিসাবমতে, গাজায় ভবন ধসে এ পর্যন্ত ৪২ মিলিয়ন টনেরও বেশি ধ্বংসস্তূপ জমা হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপগুলো যদি একসঙ্গে এক জায়গায় রাখা যায়, তাহলে তা মিসরের ১১টি গ্রেট পিরামিডের সমান হবে। এ ধ্বংসস্তূপ সরাতে ব্যয় হবে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের হিসাব অনুসারে, গাজায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৭টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা অঞ্চলটির মোট ভবনের অর্ধেকের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া এক-দশমাংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এক-তৃতীয়াংশ বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলার জন্য ২৫০ থেকে ৫০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন পড়বে। উল্লেখ্য, হিজবুল্লাহ ও ইসরাইলের মধ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে লড়াইয়ে কয়েক হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর বুধবার স্থানীয় সময় ভোর চারটার দিকে দুপক্ষের যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। লেবানন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অনেক প্রাণহানির পাশাপাশি ইসরাইল ও লেবাননের লাখ লাখ মানুষ ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইল-হিজবুল্লাহর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে ইরান। বুধবার দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানায়, লেবাননে ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধের খবরকে স্বাগত জানায় তেহরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহর প্রতি দৃঢ় সমর্থনের কথাও ব্যক্ত করেছেন। লেবাননে যুদ্ধবিরতিকে বিজয় হিসেবে উল্লাস শুরু করেছেন সেখানকার বাসিন্দারা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণার পর লেবাননে বাস্তুচ্যুত বাসিন্দারা নিজেদের এলাকাগুলোতে ফিরে আসতে শুরু করেছে।

কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই ॥ এ্যানি আক্তার

কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই ॥ এ্যানি আক্তার

কর্ম নেই। পরিবারে অসুস্থ স্বামী। দুই সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি। ছয়জন সদস্য নিয়ে সংসার। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্বামী প্রতিদিন স্বাভাবিক কাজ করতে পারেন না। মাঝে মধ্যে ছোট ছোট কর্ম করলেও বেশিরভাগ সময় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকেন। অর্থের অভাবে সুচিকিৎসা করাতে পারেন না। ছোট ছোট সন্তানকে ভালো কিছু খাওয়াতেও পারেন না। শ্বশুর-শাশুড়িকে ভালোভাবে সেবা-যত্ন করাতে পারেন না। অভাব-অনটন সংসারে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবন পার করতে হচ্ছে এ্যানির। কথার শুরুতে করুণ শুরে কথাগুলো বললেন এ্যানি আক্তার। রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া যদু ফকিরপাড়ার বাসিন্দা এ্যানি। এইচএসসি পাস করার পর অর্থের অভাবে পড়ালেখা চালাতে না পারায় বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বিয়ে হয়। স্বামী মুক্তার ফকিরের সংসারেও অভাব। অভাবের সঙ্গে যোগ হয় স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতা। অসুস্থ স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন এ্যানি আক্তার। এভাবে বেশি দিন ঘরে বসে থাকেনিন এ্যানি। কর্মের সন্ধানে ঘর থেকে বের হন। গোয়ালন্দ উপজেলা মহিলা অধিদপ্তর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়িতে বসে কাজ করেন। পরে পরিবারের অভাব কিছুটা নিরসন হয়। তবে সেই জায়গায় থেমে নেই তিনি। স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইউটিউিবে খোঁজ পায় মুড়ি ভাজা। মনোযোগ সহকারে দেখেন তিনি। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করেন। মহিলা অধিদপ্তরের গোয়ালন্দ উপজেলা কর্মকর্তা সালমা বেগমের সহযোগিতা নিয়ে শুরু করেন মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। প্রথমে একটি মেশিন, একটি ঘর ও কিছু আমানত সংগ্রহ করেন। তারপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, স্থানীয় এনজিও থেকে টাকা সংগ্রহ করে মুড়ি ভাজা শুরু করেন। স্বামী এবং শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে ধীরে ধীরে শুরু করেন মুড়ি ভাজা। তারপর বাজারজাত। এভাবে চলতে থাকে এ্যানির সংগ্রামী জীবন। মুড়ি বাজারজাত করার পর থেকে পেছনের দিকে আর তাকাতে হয়নি তাকে। গতি এখন সামনের দিকে। এ্যানি আক্তার বলেন, করুনা নয়। কর্মের মাধ্যমে ঘুরে দাঁড়াতে চাই। লজ্জা করে ঘরে বসে থাকলে কেউ খাওয়াতে আসবে না। তাই অভাব-অনটন ও দারিদ্র্যতাকে দুর্বলতা না ভেবে বরং পুঁজি করে কাজ শুরু করেছি। প্রথমে অনেক বাধা পেয়েছি। অনেকের বলতে শুনেছি নারীরা ঘরে থাকবে। সে কেন ঘর থেকে বের হবে। না, আমি পারি নাই। ক্ষুদার যন্ত্রণায় ঘরে বসে থাকতে পারি নাই। তাই পেছনের মানুষের কথায় কান না দিয়ে, ঘর থেকে বের হয়ে এসেছি। এখন আমি সকাল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত নিজের কর্মস্থানে কাজ করি। আমার কাজের সঙ্গী স্বামী এবং শাশুড়ি। পাশাপাশি আরও দুই কর্মচারী রয়েছে। মোট ৫ জন কাজ করি। নারী উদ্যোক্তা এ্যানি বলেন, এই মুড়ি স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির চুলায় ভাজা হয়। তবে একটি মেশিন শুধু মটরে ঘুরে। এতে চাল গরম করতে হয়। এর পর গ্রামীণ পদ্ধতিতে মাটির চুলায় লবণ মিশিয়ে মুড়ি ভাজা হয়। কোনো প্রকার কেমিক্যাল মেশানো হয় না। বাজারে চাহিদাও অনেক।   এ্যানি বলেন, এখন প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ’ কেজি মুড়ি ভাজতে পারি। বাজারজাতও করি। বড় পরিসরে করার ইচ্ছা আছে। ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে টাকা নিতে পারলে করা সম্ভব হতো। কিন্ত যেখানে চাই, সেখানে কঠিন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সুতরাং ব্যাংক লোন নিতে পারি না। তবে আমি হতাশা নই। আমি আশাবাদী। এলাকার একাধিক নারী-পুরুষ বলেন, মুক্তারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। বিয়ের কিছু দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু ওর স্ত্রী এ্যানি কারও সহযোগিতা না নিয়ে কাজ শুরু করেন। এখন মুড়ি ভাজার কারখানা দিয়ে অনেক ভালো আছেন। ওর সাহসিকতা দেখে এখন অনেকে এগিয়ে আসছে। তবে প্রথমে আমরা এলাকাবাসী অনেক রকম কথা বলতাম। দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, আমার জানা ছিল না যে ইউনিয়ন পরিষদের পাশে একটি মুড়ি ভাজার কারখানা আছে। সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে জানতে পারলাম। তিনি বলেন, আমি গর্বিত আমার ইউনিয়নের সাধারণ নারী-পুরুষ এখন ঘরে বসে নেই। বিভিন্ন কর্মের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে এক্ষেত্রে সহযোগিতা লাগলে অবশ্যই আমি করব। গোয়ালন্দ মহিলা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সালমা বেগম বলেন, এ্যানি মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের পরামর্শ নিয়েছে। তিনি এখন ছোট্ট পরিসরে একটি কারখানা তৈরি করেছে। যেখানে পরিবারের সদস্যসহ ৫ জন কর্ম করছে। এই নারী উদ্যোক্তা এ্যানির সামনের দিকে আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। আশা করি এ্যানির মতো অনেকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বসে না থেকে উদ্যোক্তা হবেন। মহিলা অধিদপ্তর সকলের পাশে থাকবে।   গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র বলেন, আমি এই নারী উদ্যোক্তার কারখানা ঘুরে দেখেছি। সুন্দর পরিসরে এই নারী এগিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের পক্ষ থেকে সব প্রকার সহযোগিতা করা হবে। তিনি বলেন, নারীরা এখন আর ঘরে বসে থাকে না। সব কর্মস্থানে নারীরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। উদ্যোক্তার ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে নেই। নারীরা কারও সহযোগিতা প্রত্যাশা করে না। তারা আপন গতিতে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদের সকলের উচিত নারী উদ্যোক্তাদের অসম্মান না করে বরং সার্বিক সহযোগিতা করা। এতে গ্রামীণ নারীরা আরও ভালো করবে।

অপরিপক্ব নবজাতক

অপরিপক্ব নবজাতক

অপরিণত নবজাতকের মৃত্যু। দুঃসহ বাতাবরণের করুণ আখ্যান। সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন থাকেন গর্ভধারিণী মা। দেশে অকাল মাতৃত্বের নির্মম পরিণামও বহুবার আলোচিত এক অসহনীয় বিষয়। শিশু মৃত্যু ও মায়ের স্বাস্থ্য নিবিড়ভাবে একীভূত। সঙ্গত কারণে সবার আগে এসে যায় জন্মদাত্রী মায়ের জীবনাচরণ, সংস্কার, মূল্যবোধ আর প্রচলিত বিধি তো বটেই। যে সমাজে আজও বাল্যবিয়ে কমানো গেল না তেমন পশ্চাৎপদ কাঠামোর গভীরে জিইয়ে থাকে নানাবিধ অনাসৃষ্টিও। আর বাল্যবিয়ের অপরিণামদর্শিতায় ঠেকানোই যায় না অকাল মাতৃত্বের চরম প্রকোপও। যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজের অবধারিত দুর্ভোগ। একজন শিশু কিংবা কিশোরী কন্যার বালিকা বয়সে বিয়ে হয় সেখানে ঘাত-প্রতিঘাত তো পদে পদে। পুতুল খেলার স্বাচ্ছন্দ্যময় বয়সে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। পরিণামে যা হওয়ার তা ঠেকানোর উপায় না থাকাও আর এক অকাল বোধন বলাই যায়। নতুন সময় ও যুগের নব আঙ্গিক তো নয়ই। বহু যুগ ধরে চলে আসা এক চিরায়ত অপসংস্কারের প্রবল অপঘাত। শরীর ও মনের স্বাভাবিক পরিপক্বতা, মানসিক গড়ন, বোধ-বুদ্ধি জেগে ওঠা সবই এক সুতায় গাঁথামালা। অকাল মাতৃত্বে অপরিণত শিশু জন্ম আর এক দুর্বিষহ নাকাল সময়। যথা সময়ের আগে কন্যা শিশুর গর্ভে যখন আর একটা নতুন ভ্রƒণ তৈরির সম্ভাবনা থাকে মায়ের জন্য শুভ সংকেত তো নয়ই। নতুন প্রজন্মও মায়ের গর্ভে স্বস্তি আর নিশ্চিন্তে বেড়ে উঠতেও হোঁচট খেতে হয়। এখানেই শেষ নয় কিন্তু। পরের সময়ও নিরাপত্তার বেষ্টনী বিঘ্নিত হলে মা-সন্তান উভয়েই পড়ে চরম বিপাকে। জন্ম যখন চরম দুঃসময়ের আবর্তে মৃত্যুও যেন হাতছানি দেওয়ার দুরবস্থায়। ‘বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উত্তরণ’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে আসে। বলা হচ্ছে দেশের ১৬ শতাংশ শিশুর জন্ম অকালে, শারীরিক ও মানসিক অপরিপক্বতায়। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত কম ওজনের ৩ সদ্যভূমিষ্ঠ শিশু অসময়ে চলে যাওয়া পারিবারিক এক দুঃসহ পরিস্থিতি। প্রতিরোধ কিংবা চিকিৎসাহীনতা সব সময় প্রশ্নবিদ্ধ। তবে সম্মুখ সমরে মা ও শিশুকে লড়াই করতে হয় বাঁচার তাগিদে। আইসিডিডিআরবি আর পিজির যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় মা ও সদ্যজাত শিশুর ওপর এক সময়োপযোগী কর্মশালা। গবেষক, বিশ^বিদ্যালয়ের চিকিৎসক ছাড়াও সরকারি কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে কর্মশালার বিরাট আয়োজনে মা ও শিশুর ওপর প্রাসঙ্গিক তথ্য-উপাত্ত উঠে আসে। এমন সম্মিলন সভায় বলা হয় চিকিৎসা যা আছে তাও ব্যবহার হচ্ছে না। এটাই নিরেট বাস্তবতা। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক গবেষক ও বিজ্ঞানীদের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় হরেক দিকনির্দেশনাও তুলে ধরা হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রƒণের অবস্থান, সময়, বেড়ে ওঠার পরিবর্তনও দর্শক-শ্রোতাদের অবহিত করা হয়। মাকে কততম সপ্তাহে অত্যন্ত সতর্ক, সাবধানতায় চলাফেরা করতে হয় তাও নির্দিষ্টভাবে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ না হলে শিশুর শরীর-স্বাস্থ্য অপরিপক্বই থাকে। গর্ভপাত হওয়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শিশু মায়ের জঠরে নিরাপদ বেষ্টনীতে থাকার সময় মোট ৪০ সপ্তাহ। তার আগে জন্ম মা ও শিশুর জন্য অমঙ্গল ডেকে আনার দুর্বিপাক। একজন সুস্থ, সবল মা-ই পারেন দেশের আগামীর প্রজন্মকে সুন্দর পৃথিবীর আলো দেখাতে। মায়ের স্বাস্থ্যই যদি বিপন্নতার আবর্তে পড়ে তা হলে গর্ভজাত সন্তানের নিরাপত্তার বলয় কোথায়? প্রশ্ন উঠতেই পারে। সঙ্গত কারণে অপরিণত শিশু ও মাতৃগর্ভ থেকে কিছু রোগ-বালাই নিয়ে আসে। শ^াসকষ্ট, জন্ডিস এবং রক্তস্বল্পতার আকালে পড়তেও সময় লাগে না। তার সঙ্গে যুক্ত হয় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চাইতে কম থাকা। যা সদ্যজাত শিশুর জন্য নিরাপদ কিংবা স্বস্তিদায়ক হয়ই না। ফলে সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ঝুঁকির আবর্তে পড়ে। বিভিন্ন রোগ সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার দুরবস্থাও ঠেকানো মুশকিল। সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া, মৃগি রোগ এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিকতার সমস্যাও মাথাচাড়া দেয়। সব মিলিয়ে শরীর যেমন আক্রান্ত থাকে পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যও বিগড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পড়ে যায় নবজাতক। এমন শরীর ও মনের বিপন্নতা নিয়ে শিশু জন্ম হার নাকি বাংলাদেশেই বেশি। বিশে^র ১০৩টি দেশ নিয়ে করা গবেষণা তথ্যে এমন বিপন্ন চিত্র বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মের অশনি সংকেত। শুধু কি তা-ই? সন্তান ভূমিষ্ঠ করা মায়ের স্বাস্থ্য অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা দেশের জন্য ভালো কিছু নয়। আর এমন কম ওজন আর স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে জন্ম নেওয়া নবজাতকরা পরিবার থেকে সার্বিক সামাজিক পরিসীমায় এক প্রকার আশঙ্কার মধ্যেই জীবন কাটানো সংশ্লিষ্টদের জন্য মারাত্মক দুরবস্থা। স্বাস্থ্য আর মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকা কষ্টকর এবং জীবন প্রবাহ। যাতে শুধু মা-শিশুই নয় পারিবারিক নির্মল আঙিনাও বেসামাল হতে সময় লাগে না। বিশে^র বিভিন্ন দেশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিপন্ন শিশুদের নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন থেকে স্বাস্থ্য বিষয়ক সুরক্ষা ছাড়াও ঝুঁকিপূর্ণ রোগ-বালাই চিহ্নিত করে সমাধানের পথও নির্দেশ করা হয়েছে। এমন বিপন্ন নবজাতকের মধ্যে কন্যার চাইতে পুত্রের সংখ্যা বেশি বলে গবেষণা প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশে বিশেষ জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে নবজাতকের শারীরিক দৌর্বল্য ও মৃত্যু ঠেকানো যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা অভিমত ব্যক্ত করছেন। বিশেষ করে আপাতত দীর্ঘকাল চলে আসা কিছু অপসংস্কার দূর করতে পারলে সার্বিক না হোক আংশিক সমাধান বিপন্ন প্রতিবেশের ন্যায্যতা। বাল্যবিয়ে, নারী নির্যাতন, পরিবেশ দূষণ থেকে মা-শিশুকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসতে পারাও সময় ও আকাল পরিস্থিতির ন্যায্যতা। আর বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্য ঝুঁঁকির বিপন্নতায় আক্রান্ত নবজাতকের জন্য দেশে সুচিকিৎসা আছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও যা আছে তাই দিয়ে নবজাতকের সযত্ন পরিচর্যা দরকার।

মায়ের পুষ্টিতে শিশুর স্বাস্থ্য

মায়ের পুষ্টিতে শিশুর স্বাস্থ্য

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যে নতুন সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় ক্রিয়াশীল তাতে নানামাত্রিক অসমতাও দৃষ্টিকটু। সমাজের সমসংখ্যক নারীর জীবন ও স্বাস্থ্য সন্তানের স্বাচ্ছন্দ্যময় এগিয়ে চলার নিয়ামক শক্তি। বিশ^ সৃষ্টির ঊষা লগ্ন থেকেই জন্মদাত্রী মায়ের পরিচয় ছিল আদিম বন্য দশার এক অভাবনীয় এগিয়ে চলা। অবাধ স্বেচ্ছাচার আর দলগত বিয়েতে পিতৃ পরিচয়ের সুযোগই ছিল না। মায়ের জঠর থেকে সন্তানের ভূমিষ্ঠ ইতিহাসের আর এক গৌরবোজ্জ্বল পালাক্রম তো বটেই। তাই পারিবারিক বলয় শুরু হওয়ার প্রারম্ভিক পর্যায় ছিল কাদের নিয়ে আদিম বন্য মানুষেরা পরিবার গঠন করবে। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো ছিটানো আদিম গোষ্ঠী যখন পরিবার নামক সমাজ সংগঠনেরও ভিত্তি তৈরি করে সেখানে সবার আগে সামনে এসে যায় মাতৃত্বের অপার মহিমা। শুধু কি তাই? মায়ের গর্ভ থেকে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়াও ছিল আর এক অরুণোদয়ের অনন্য দীপ্তি। পিতৃ পরিচয় তখন অবধি সুদূর পরাহত। দলগতভাবে যে পরিবার আদিম সমাজে সংহতি তৈরি করে তা ছিল কিন্তু মাতৃতান্ত্রিক আবহ। আগেই উল্লেখ করা হয় সন্তানের জন্মদাত্রী চিহ্নিত হলেও পিতার পরিচয় জানতে মানবগোষ্ঠী আরও অপেক্ষমাণ থাকতে হয়েছে। কোনো এক সময় একক বিবাহে মানবজাতি সংগঠিত হলে পিতার পরিচয়ও চলে আসে প্রশ্নাতীতভাবে। তাতে কি মায়ের মহিমার ক্ষুণ্ন্ন হয় কখনো? সেই আদি সমাজ থেকে আজ অবধি জঠরে ধারণ করে সন্তানকে লালন করা। কোনো এক শুভ মুহূর্তে পৃথিবীর আলো দেখানো মাতৃত্বের চিরস্থায়ী রূপ শৌর্যের আজ অবধি কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু সভ্যতার চরম উৎকর্ষে বিজ্ঞান যখন বিশ^কে নতুন আলোর কিরণছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন থেকে সমসংখ্যক নারীর জীবন অসমতা, বৈষম্য এবং নির্যাতনের চরম আকালে পরিণত হওয়াও সভ্যতা সূর্যের কালো দাগ। কিন্তু নারীর যে সফল ও মহিমান্বিত রূপ মাতৃত্বে তাতে সামান্যতম স্খলন না হওয়াও আধুনিক প্রযুক্তির আলোকিত পরিবেশের পরম নির্মাল্য। কিন্তু হরেক অসমতা আর দৃষ্টিকটু বিভাজনে নারীর যে অনাকাক্সিক্ষত পিছু হটা তাও সমাজ সভ্যতার অধোগতি। আধুনিকতার নতুন সময়েও বলা হচ্ছে সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তানের জন্য মায়ের বিকল্প অন্য কিছুই নয়। তা কিন্তু জঠরে লালন পালন করা থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা এক পর্যায়ক্রমিক এগিয়ে চলা। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর মায়ের নিবিড়তম ছোঁয়া ছাড়াও স্বাস্থ্যগত অবস্থারও পরম নিশানা। বলা হচ্ছে একজন সুস্থ মাই জাতিকে শ্রেষ্ঠ সন্তান উপহার দিয়ে পুরো গঠন প্রক্রিয়ায় যে অবারিত ভূমিকার দায়িত্ব পালন করে যায় তাও এক অমূল্য সম্পদ দেশের জন্য। সঙ্গত কারণে মাতৃস্বাস্থ্য ও নতুন সময়ের যুগ পরিক্রমায় এক অতি আবশ্যক সম্ভার, সম্বল তো বটেই। তবে দুর্বল ও রুগ্ন মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যেমন নিজে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন তার চেয়ে বেশি সংকটাপন্ন হতে থাকে নতুন প্রজন্মের বিপন্ন শিশুটি। তাই মায়ের স্বাস্থ্যগত সচেতনতা আগামী প্রজন্মের নতুন জীবন গড়ার সবচেয়ে নিয়ামক শক্তি। সঙ্গত কারণে বৈষম্যহীন নতুন সরকার গঠন কার্যক্রমে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও নজরদারিতে থাকা সময়ও পরিস্থিতির অনিবার্যতা। নারী সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা সময়ের যোদ্ধারা বলছেন নারী স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ সচেতনতা একান্ত জরুরিই শুধু নয় নবজাতকের প্রতি দায়বদ্ধতাও বটে। নারীর অপুষ্টিকে দূর করতে নতুন নীতিমালা ও কর্মসূচি অত্যাবশ্যক। যার জন্য পুরো ব্যবস্থাপনার নীতি ও কৌশল আধুনিক সময়ের প্রাপ্যতা। নারী নেত্রীরা আপত্তি তুলছেন এখনো সমাজের বৈষম্যমূলক পুরনো অপসংস্কারে সমসংখ্যক ভুক্তভোগী। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দৃশ্যমান হচ্ছে দেশের সন্তানসম্ভবা মায়েদের অর্ধেকই রক্ত স্বল্পতায় আক্রান্ত। যা শিশু জন্ম থেকে আরম্ভ করে সার্বিক জীবনের এক করুণ অধ্যায়। আর এমন দুর্বিপাকের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন হয়ে আছে স্বাধীনতাহীনতা আর অধিকার আদায়ে ক্রমান্বয়ে পিছু হটা। আমরা এখনো সেই পারিবারিক বলয়ের চিরস্থায়ী সামাজিক সংগঠনের মধ্যে মিলে মিশে বাস করি। পরিবার এখনো সমাজের আদি ও অকৃত্রিম প্রতিষ্ঠান। তাই মাতৃস্বাস্থ্যের সার্বিক দেখভালও ছোট্ট সংগঠন পরিবার থেকে শুরু করা বাঞ্ছনীয় এবং ন্যায্যতা। দেশের এখনো সিংহভাগ এলাকা গ্রামীণ পরিবেশে টিকে আছে। তাই পরিবার থেকেই নারী স্বাস্থ্যের বিশেষ কার্যক্রম এগিয়ে নিতে সার্বক্ষণিক কর্মযোগ অব্যাহত রাখাও জরুরি। একান্নবর্তী পরিবার হলে অন্যান্য সদস্যের দায়বদ্ধতা এসে যায়। গর্ভবতী মায়ের সেবা-যত্ন পুষ্টিকর খাদ্য পরিবেশন সবই। গাফিলতিটা হয় কিন্তু সেখানেই। আর একক পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর যে বন্ধন সেখানে স্বামী যদি সচেতন থাকেন অন্য কোনো ঝুঁকি কিংবা ঝামেলা অবকাশই থাকে না। গৃহিণী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের আয়োজন তো বটেই। কর্মজীবী অন্তঃসত্ত্বা মায়ের জন্যও জরুরি সব ধরনের প্রাসঙ্গিক ব্যবস্থাপনার। পুষ্টিকর খাবার মা ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য এক অপরিহার্য বিষয় সেখানে গর্ভবতী মাকেও তার স্বাস্থ্য আর সন্তানের বিশেষ যত্ন আত্তির পালন করাও প্রতিদিনের অতি আবশ্যক কর্তব্য। সেখানে কোনো গাফিলতি কিংবা ঘাটতি মা ও আগত শিশুর স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা বিচলিত হওয়ারই মতো। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ও নৈমিত্তিক এবং প্রাসঙ্গিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে একজন স্বাস্থ্যকর মাই একটি সুন্দর ও পরিচ্ছিন্ন জাতি উপহার দিয়ে দেশ ও জনগণকে সমৃদ্ধির পথে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিত করতে পারেন।

গ্রামীণ নারীর শিক্ষা

গ্রামীণ নারীর শিক্ষা

ব্রহ্মপুত্র নদের পারে চিলমারী উপজেলা। এই উপজেলার মানুষ নদীভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। এক সময়কার বড় গৃহস্থ নদী ভাঙনের স্বীকার হয়ে সব হারিয়ে হয়ে যায় শ্রমজীবী মানুষ। দুর্গম এ এলাকার মানুষ নানা অনিশ্চয়তার মাঝে তাদের সন্তানদের লালন-পালন করে। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানদের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। বাল্যবিয়ে এখনো হয় অনেক বেশি। দুর্গম চরাঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও নেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। প্রাইমারী পাস করার পর মেয়ে শিশুদের বাড়িতেই থাকতে হয়। এক অনিশ্চয়তার মাঝে কাটে তাদের জীবন। এমতাবস্থায় তাদের বিয়ে দিয়ে দেয় অভিভাবকরা। কিন্তু সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখনকার মায়েরা তাদের কন্যা সন্তানদের সময় উপযোগী করে বাল্যবিয়ে দিতে বাধা দিচ্ছে। এ কারণে ঐসব এলাকায় বেড়েছে মেয়ে শিশুর শিক্ষার হার। মেয়েরা মুক্তি পাচ্ছে বাল্যবিয়ের হাত থেকে। এমনি এক মা চিলমারীর রাজার ভিটার গ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদের পারের গৃহবধূ লিপি বেগম। শুধু বাড়ির ভিটাটি ছাড়া আর কিছু নেই। এক বছর আগে স্বামীর মৃত্যু হয়। তিন সন্তানকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়ে লিপি বেগম। সংসারে উপার্জন করার কেউ না থাকায় বড় মেয়ে আঁখি তারার বিয়ের বয়স না হলেও গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনদের চাপে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাধা দেয় স্থানীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরডিআরএস। তাদের কর্মীবৃন্দ এগিয়ে আসে। লিপি বেগমকে বাল্যবিয়ের কুফল জানায়। সহায়তা করে ১৭ হাজার টাকা। তাই দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে শুরু করে দর্জির কাজ। তাকে ঐ সংস্থা প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে। লিপি বেগম সন্তানদের পড়াশোনা করার অঙ্গীকার করেন। সরে আসেন সন্তানের বাল্যবিয়ে থেকে। প্রতিদিন সেলাই মেশিন দিয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে কোনো রকমে চলে তার জীবন আর সন্তানদের পড়াশোনা। পরে প্রকল্পের কর্মকর্তা ও মাঠ কর্মীদের পরামর্শে ছাগল পালন শুরু করেন। এতে দ্রুত সংসারের উন্নতি হতে থাকে। একদিকে বাড়িতে সেলাইয়ের কাজ ও অন্যদিকে ছাগল এবং হাঁস মুরগি পালনে আলোর মুখ দেখে লিপি বেগম। এক বছরের মধ্যে সংসারের অভাব অনটন দূর হতে শুরু করে। লিপি বেগম শান্তির ছায়ার এখন সুখের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। তিনি জানান, এক ছেলে ও দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাবেন। তারা যতদূর পড়াশোনা করতে চায়। তারা যেন দেশের মানুষের উপকার করতে পারে। এ স্বপ্ন দেখেন।  শুধু সে নয় রমনা খামার এলাকার শাহানা বেগমের চার সন্তান নিয়ে অভাবী সংসার। সংসারে টানাটানির কারণে অল্প বয়সেই দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এবং তৃতীয় মেয়ে মুক্তা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন পরে আর ডি আর এস  চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যম্যে বাল্যবিয়ের কুফল জানতে পারেন এবং তাদের দেওয়া ১৭ হাজার টাকা ও পরামর্শে ছাগল পালন ও সবজি চাষ শুরু করেন এবং সফলাতার মুখ দেখেন ধীরে ধীরে টাকা জমিয়ে স্বামীকে নৌকাও কিনে দেন। মেয়ে মুক্তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে। এখন মুক্তা পড়াশোনা করছে। আর শাহানা বেগমের সংসারে সুখের আলো ফুটতে শুরু করেছে। একই উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের সরদারপাড়া গ্রামের বিধবা খাদেজা বেগম। স্বামী মারা যাওয়ার পর গ্রামবাসীর সহয়তায় বাড়িতেই কাপড়ের ব্যবসার সঙ্গে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। বর্তমানে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনের চাপেও মেয়েকে  বাল্যবিয়ে থেকে বিরত রেখে পড়াশোনা চালাচ্ছেন। তিনি তাকে উচ্চশিক্ষিত করে শিক্ষক বানাতে চান। এমনিতেই চর এলাকায় শিক্ষিত মানুষের খুব অভাব। এখানকার শিশুরা অযত্নে অবহেলায় বড় হচ্ছে। তাই তার প্রত্যাশা তার সন্তান শিক্ষিত হয়ে এসব অবহেলিত শিশুদের পাশে যেন থাকে। এক অনুসন্ধানে জানা গেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আরডিআরএসের চাইন্ড নট ব্রাইড প্রকল্পের মাধ্যমে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১৬২টি পরিবারকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে সচ্ছলতা ফিরে এনেছে। এবং এসব পরিবারের মেয়েদের বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছে। এই প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ‘কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলা বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ উপজেলা। এখানে বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ নদী ভাঙন ও দরিদ্রতা। লিপি, শাহানাদের মতো হাজারো পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্যবিয়ে না দেয়।