প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের কিছু পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও ব্যবসায়ীরা শিল্প উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার দেওয়া পৃথক পৃথক প্রতিক্রিয়ায় ব্যবসায়ীরা বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটে শিল্প খাত আরও চাপে পড়বে। বাজেটের মাধ্যমে শুল্ক ও কর বাড়ানো হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি অর্থনীতিতে একটি ক্রাউডিং আউট প্রভাব তৈরি করতে পারে, যার ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতির চাপ।
তারা আরও বলছেন, কিছু ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও, বাজেটটিকে বেসরকারি খাতের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ হিসেবে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক এবং স্টার্টআপদের জন্য নেই কার্যকর প্রণোদনা। তাই অধ্যাদেশ আকারে জারির আগে এসব বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বৃহৎ শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বলছে, আইএমএফের ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর-জিডিপির অনুপাত উন্নীত করতে গিয়ে করদাতাদের ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপানোর সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। তবে বাজেটকে সঠিকভাবে বাবায়ন করতে হলে বাজেট ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা, করনীতি সংস্কার, করব্যবস্থার অটোমেশন, কর সংগ্রহে সামগ্রিক সিস্টেম লস কমানো এবং কর প্রশাসনের সক্ষমতা বৃদ্ধি তথা জনগণকে যথাযথ সেবা প্রদানের আরও সুযোগ রয়েছে বলে চেম্বার মনে করে।
প্রতিক্রিয়ায় এমসিসিআই আরও জানায়, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার ফলে সরকার দুই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে; প্রথমত, ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি অর্থনীতিতে একটি ক্রাউডিং আউট প্রভাব তৈরি করতে পারে, যার ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগকারীদের জন্য অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। দ্বিতীয়ত, সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে, যে চাপ শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয় ভোক্তা বা জনগণকে। তাই এমসিসিআই এই দুই বিষয়ের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করছে। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের পুনর্গঠনের জন্য বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন বলে এমসিসিআই মনে করে।
অপরদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব নয় মন্তব্য করে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেছেন, এবারের বাজেটে রেভিনিউ আহরণকে প্রধান লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে, করজাল বাড়ানোর কার্যকর কোনো দিকনির্দেশনা নেই। কর আদায়ের পদ্ধতিগত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও করপোরেট ও ব্যক্তি খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এতে করে উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আনোয়ার-উল আলম বলেন, আইএমএফের ফর্মুলা অনুযায়ী বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে শিল্প খাত আরও চাপে পড়বে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি, উচ্চ সুদের হার ও আমদানি ব্যয় এমনিতেই শিল্পকে সংকটে ফেলেছে। এর মধ্যে আবার শুল্ক ও কর বাড়ানো হলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, রপ্তানিমুখী খাতের জন্য নগদ প্রণোদনা ক্রমান্বয়ে কমানো হচ্ছে, অথচ বিকল্প কোনো প্রণোদনা বা ফিসকাল সাপোর্ট রাখা হয়নি। কটন সুতা ও ম্যান-মেইড ফাইবারের ওপর ভ্যাট ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করায় দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো বিপদে পড়বে এবং আমদানিনির্ভরতা বাড়বে।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) প্রস্তাবিত বাজেটের কয়েকটি ইতিবাচক দিকের প্র্রশংসা করেছে। এসব পদক্ষেপ হলো- করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি, জুলাই যোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধা এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য তহবিল। এতে নি¤œআয়ভুক্ত মানুষ স্বস্তি পাবে। নারীর অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করবে। এ ছাড়া কাঁচামাল ও ওষুধে শুল্ক হ্রাস উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য লাভজনক।
আইবিএফবি বলছে, ইতিবাচক দিক সত্ত্বেও, বাজেটটিকে বেসরকারি খাতের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ হিসেবে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি। কর প্রশাসন, ঋণ টেকসইকরণ এবং সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনায় কোনো মৌলিক সংস্কার দেখা যায়নি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, রপ্তানিকারক এবং স্টার্টআপদের জন্য নেই কার্যকর প্রণোদনা। খেলাপি ঋণ, সুদের হার সমস্যা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
আইবিএফবি অবাস্তব রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রাকে অবাস্তব হিসাবে মনে করছে। সংগঠনটি বলছে, রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর কর সংস্কার ছাড়া অর্জনযোগ্য নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে লক্ষ্য নির্ধারণ আছে, কিন্তু বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নেই।
আইবিএফবি কর ব্যবস্থার সংস্কার, বেসরকারি খাতকে উদ্দীপনা প্রদান, ব্যাংকিং খাত সংস্কার,
খেলাপি ঋণ কমানো, সুশাসন নিশ্চিত করা ও কম সুদে ঋণ সহজলভ্য করা, সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা এবং সরবরাহ চেনের জটিলতা দূর করে পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার সুপারিশ করেছে।
আইবিএফবি আশা করে, সরকার বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনবে। একটি সংস্কারমুখী, দক্ষতাভিত্তিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেটই হবে বাংলাদেশের জন্য টেকসই উন্নয়নের সোপান।
গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহৃত মাইক্রোবাসের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হাইব্রিড গাড়ির শুল্ক-করহার পুনর্বিন্যাসের দাবি জানিয়েছে গাড়ি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)। এক প্রতিক্রিয়া বারভিডা নেতৃবৃন্দ জানান, দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় কর ছাড়সহ যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। কৃষি খাতে প্রণোদনার পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র আমদানিতে অগ্রিম কর এবং উৎপাদনে ভ্যাট তুলে দেওয়ার প্রস্তাব সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী উদ্যোক্তাদের বার্ষিক টার্নওভার ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
তবে প্রস্তাবিত বাজেটের সঠিক বাস্তবায়নে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বিনিয়োগ, উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং কাক্সিক্ষত রাজস্ব আহরণের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল পদক্ষেপ গ্রহণ বিশেষ জরুরি বলে বারভিডা জানিয়েছে।