চেঙ্গিস খান— ইতিহাসের অন্যতম প্রতাপশালী সম্রাট, যিনি মাত্র ৪৫ বছরের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক সাম্রাজ্য। তার জীবন যেমন রহস্যময়, তেমনই মৃত্যু এবং কবরও ঘিরে রয়েছে অজস্র কল্পকাহিনি ও বিতর্ক। প্রায় ৮০০ বছর ধরে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা তার চিরনিদ্রার স্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করে গেলেও আজও তার প্রকৃত সমাধিস্থল অধরাই রয়ে গেছে।
চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর কারণ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে একাধিক মত। কেউ বলেন, তিনি শত্রুপক্ষের বিষ পান করে মারা গিয়েছিলেন, আবার কারও দাবি, এক চীনা রাজকুমারী তাকে এমন কৌশলে হত্যা করেন, যা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অন্য একটি মতানুসারে, তিনি বুনো ঘোড়া ধরতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আহত হন, কিংবা শিকারের সময় বুনো শুকরের আক্রমণে গুরুতর জখম হন এবং ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করেন। তবে নিশ্চিতভাবে জানা যায়, তিনি চীনের শিয়া সাম্রাজ্য দখলের সময়ই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তার কবর গোপন রাখার পরিকল্পনাও ছিল অভিনব। ইতিহাস বলে, তার কফিন বহনকারী সৈন্যরা পথে যাকে দেখেছে, তাকেই হত্যা করেছে, যেন কেউ তার শেষ ঠিকানার সন্ধান দিতে না পারে। যখন নির্দিষ্ট স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়, তখন এক হাজার ঘোড়া দিয়ে সেই স্থান সমান করে দেওয়া হয়। কেউ কেউ মনে করেন, তার কবরের ওপর দিয়ে নদীর প্রবাহ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে কবরের কোনো চিহ্ন না থাকে। এখানেই শেষ নয়। কথিত আছে, কবর দেওয়ার পর সেই সৈন্যদেরও হত্যা করা হয়, যাতে তারা কারও কাছে কবরের অবস্থান ফাঁস করতে না পারে। এরপর দ্বিতীয় দফায় হত্যাকাণ্ড চলে, যেখানে তাদের হত্যাকারীদেরও নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। ফলে চেঙ্গিস খানের চিরনিদ্রার স্থান আজও এক রহস্য।
শত বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকরা নানা উপায় অবলম্বন করেও চেঙ্গিস খানের কবরের সন্ধান পাননি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পর্যন্ত স্যাটেলাইট ব্যবহার করে সম্ভাব্য স্থানগুলো চিহ্নিত করে, যেখানে কয়েকটি প্রাচীন কবর খুঁজে পাওয়া গেলেও, চেঙ্গিস খানের কবর পাওয়া যায়নি। আরেকটি বড় বাধা হলো মঙ্গোলিয়ানদের বিশ্বাস ও ঐতিহ্য। চেঙ্গিস খানকে তারা আজও তাদের মহানায়ক বলে মনে করেন, ফলে তারা চান না তার কবর কেউ আবিষ্কার করুক। এমনকি যেখানেই তার কবর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই বুরখান খালদুন পাহাড় জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত হয়েছে, যার ফলে সেখানে খননকার্য পরিচালনাও নিষিদ্ধ।
চেঙ্গিস খানের কবর নিয়ে কেবল গবেষণাই নয়, প্রচলিত রয়েছে নানা কুসংস্কারও। কথিত আছে, তার কবর আবিষ্কার হলে পৃথিবীতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। এই বিশ্বাস আরও শক্ত হয়, যখন তৈমুর লং-এর কবর খোলার পরপরই জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর হামলা চালায় এবং শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
৮০০ বছর পার হয়ে গেলেও চেঙ্গিস খানের কবর আজও রহস্যময়। গবেষণা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির পরও কি তার সমাধির সন্ধান মিলবে? নাকি ইতিহাসের এই ভয়ংকর যুদ্ধবীর চিরকালই রয়ে যাবেন অজানা গন্তব্যে? এই প্রশ্নই রয়ে গেছে বিশ্ববাসীর মনে।
ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/7T3jegJCWQc?si=oyQWfG1IiCUN0ep3