বাংলা ভাষার ডিজিটাল বিপ্লবের অন্যতম অগ্রদূত মেহেদী হাসান খান ও বিজয় কিবোর্ডের নির্মাতা মোস্তফা জব্বারের মধ্যে বহু বছর ধরে চলা বিরোধের মূল কারণ কী? বাংলা টাইপিং সফটওয়্যার নিয়ে যে সংঘাত, তার পেছনে রয়েছে বাণিজ্যিক স্বার্থ, কপিরাইট বিতর্ক এবং প্রযুক্তির গণতন্ত্রায়নের লড়াই।
বিগত শতকের শেষের দিকে ও নতুন শতকের শুরুতে বাংলা টাইপিং ছিল বেশ ব্যয়বহুল এবং সীমাবদ্ধ। বিজয় কিবোর্ড দীর্ঘদিন ধরে বাংলা টাইপিংয়ের একমাত্র জনপ্রিয় সফটওয়্যার হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করছিল, যার জন্য ব্যবহারকারীদের মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হতো। ঠিক সেই সময় ২০০৩ সালে, মাত্র উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র মেহেদী হাসান খান নিয়ে আসেন অভ্র কিবোর্ড, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
অভ্রর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এটি ইউনিকোড-ভিত্তিক, যার ফলে একবার টাইপ করা লেখা যে কোনো ডিভাইসে সহজেই দেখা যেত। অভ্র আসার পরই বাংলা টাইপিং গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে এবং দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই জনপ্রিয়তা বিজয়ের একচেটিয়া বাজারকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।
২০১০ সালের ৪ এপ্রিল, বিজয়ের নির্মাতা মোস্তফা জব্বার দাবি করেন যে, অভ্র কিবোর্ড বিজয়ের লেআউট চুরি করেছে এবং এটি কপিরাইট লঙ্ঘন করেছে। তিনি অভ্র নিষিদ্ধ করার জন্য নানা আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেন এবং অভ্র`র বিরুদ্ধে কপিরাইট মামলা দায়ের করেন।
অভ্রর জনপ্রিয়তার কারণে বিজয়ের বাজার ক্ষতির মুখে পড়ে, বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অভ্র ব্যবহারের দাবি উঠতে থাকে। বিজয় এতদিন ধরে বাংলার একমাত্র স্বীকৃত সফটওয়্যার হিসেবে জায়গা ধরে রাখলেও অভ্র আসার পর সেটি অনেকাংশেই পরিবর্তিত হয়।
মেহেদী হাসান খান এই বিতর্কের পর অভ্র থেকে বিজয় লেআউটটি সরিয়ে ফেলেন, এবং মামলাটিও পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়। তবে অভ্র পুরোপুরি নতুন কোডিং ও ইউনিকোড-ভিত্তিক হওয়ায় এটি বিজয়ের সঙ্গে তুলনীয় নয় বলে প্রযুক্তিবিদেরা মত প্রকাশ করেন।
অভ্রর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিনামূল্যে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মেহেদী হাসান খান ও তার দলকে ২০২৪ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। প্রথমে মেহেদী এককভাবে মনোনীত হলেও, তিনি তার সহকর্মী রিফাত নবী, তানভীন ইসলাম সিয়াম ও শাবাব মোস্তফার নামও একুশে পদকের জন্য অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান।
এই স্বীকৃতি আসতে দীর্ঘ সময় লেগে গেলেও, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, পূর্ববর্তী সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে মোস্তফা জব্বারের অবস্থান থাকায় অভ্রর অবদান এতদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়নি।
এই বিরোধ শুধু দুজন প্রযুক্তিবিদের মধ্যে নয়, এটি আসলে বাণিজ্যিক সফটওয়্যার বনাম ওপেন সোর্স প্রযুক্তির মধ্যে লড়াইয়ের প্রতিফলন। বিজয় একটি বাণিজ্যিক সফটওয়্যার, যা কিনতে অর্থ খরচ করতে হয়, অন্যদিকে অভ্র একটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার, যা সবার জন্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত।
বছরের পর বছর ধরে এই বিতর্ক চললেও, বর্তমানে অধিকাংশ ব্যবহারকারী অভ্রর সুবিধা গ্রহণ করছেন এবং এটি বাংলা ভাষার ডিজিটাল প্রসারের ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে।
একুশে পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে মেহেদী হাসান খান ও তার দল যে অবশেষে তাদের প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন, এটি বাংলা ভাষার জন্য নিঃসন্দেহে এক বিশাল অর্জন।
ভিডিও দেখুন: https://youtu.be/A-1vaSm1f-k?si=2QBv1fHqW5-W43Xu